চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

উচ্ছেদে গা-ছাড়া, দখলে ওরা কারা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১:১৬ অপরাহ্ণ

ঢিলেঢালাভাবে চলছে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম। পক্ষান্তরে অপ্রতিরুদ্ধ গতিতে চলছে দখলযজ্ঞ। প্রশাসনের দায়সারা ও গা-ছাড়াভাবের কারণে দখলদারিত্ব থামানো যাচ্ছে না বলে দাবি পরিবেশবাদীদের।
উচ্চ আদালতের আদেশে গত বছর নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছিল জেলা প্রশাসন। পরে যুক্ত করা হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকেও। কিন্তু দুই সংস্থা ঢিলেমির সুযোগে চলছে দখলদারিত্ব। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা গিলে খাচ্ছে ভূমিখেকোরা।
সেতুকে ঘিরে দখলরাজ্য :
সরেজমিন দেখা যায়, শাহ আমানত সেতুকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে বালু মহাল, বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড, পণ্য ওঠা-নামার ঘাট, মাছের বাজার, দোকান ও নানা স্থাপনা। সরকারি খাস জমি ও সওজের জায়গা দখল করে নতুন নতুন এলাকা বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
গতকাল দুপুরে দেখা যায়, নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ সেই ইটভাটার পাশে বালুমহাল গড়ে ওঠেছে। স্কেভেটর দিয়ে বালু রাখার জন্য সেতু ঘেঁষে পুকুরসদৃশ্য বিশাল গর্ত করা হয়েছে।
২০১২ সালে ড্রেজিং প্রকল্পের ঠিকাদার জাফর আলম (বালু জাফর) ও বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী (বর্তমানে কারাবন্দী) নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলেছিলেন প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিস অটো গ্রিন ব্রিকস্ নামের এই ইটভাটা। ২২ দশমিক ১৪ একর জায়গা দখল করে ইটভাটা নির্মাণ করা হয়। ২০১৪ সালে তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে ভূমিমন্ত্রী) সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে সেই ইটভাটা বন্ধ করে দেয়। এখন ইটভাটার আশপাশের জায়গা ধীরে ধীরে বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় শ্রমিক কামাল উদ্দিন জানান, পটিয়ার হুলাইন গ্রামের নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি বালুমহালটি নির্মাণ করেছে। মহালটি নদীর তীরে ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে বন্ধ করে দেওয়ার পর ইটভাটার পাশে মহাল নির্মাণ করা হয়েছে।
নদীর তীরে ড্রেজিং মাটি রাখার প্রস্তুতি চলছে। দুটি স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে।
সেতুর পশ্চিম পাশে দেখা যায়, রাজাখালী খাল ও নদীর তীর দখল করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে জেটি-ঘাট। ক্রেন ও শ্রমিক দিয়ে এ ঘাটে আমদানি করা বড় কাঠ থেকে শুরু করে রড়-সিমেন্ট, পাথর ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে বোঝাই করা হয়। এ অবৈধ ঘাট থেকে দিনের অন্তত ৫০ হাজার টাকার চাঁদা উত্তোলন করা হয় বলে জানায় শ্রমিকেরা। কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা এলাকার সাবেক এক চেয়ারম্যানের ছেলে সেকান্দর হোসেন রানা ও চাঁন মিয়া-দুইজনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই অবৈধ সাম্রাজ্য।
সেকান্দর হোসেন রানা দাবি করেন, ‘সরকারি জায়গা পড়ে রয়েছে। যে যার মতো করে দখল করছে। আমরা জায়গা ভাড়া নিয়ে বালু বিক্রয়কেন্দ্র করেছি। পাথরের ব্যবসা করছি। সুবিধা থাকায় পাথর উঠানো-নামানো হয়। এখানে ঘাট বা জেটিঘাট বলতে কিছুই নেই।’
এছাড়াও সেতু নিচ এলাকা ও নদীর তীর দখল করে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের অবৈধ স্ট্যান্ড বানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এন্ড মিনি ট্রাক মালিক গ্রুপের নাম দিয়ে সরকারি জায়গা দখল করে এই স্ট্যান্ড নির্মাণ করা হয়েছে। সংগঠনের নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। প্রতি গাড়ি থেকে ৭০ থেকে এক শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয় বলে জানান একাধিক মালিক।
তবে মালিক গ্রুপের সভাপতি ফরিদ আহমদ দাবি করেন, ‘আমরা কোনো চাঁদা নিই না। যারা জেটিঘাট নির্মাণ করেছেন তারা টাকা নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পণ্য পরিবহনগুলো যানজট নিরসনের জন্য এখানে রাখা হয়। এটি সরকারি জায়গা। সরকার চাইলেই আমরা তা ছেড়ে দিতে বাধ্য।’
সরকারি খাস জমি ও সওজের জায়গা প্রতিনিয়ত দখলদারিত্ব চলে আসছে দায়সারাভাব সরকারি দুটি সংস্থার। গত ১২ সেপ্টেম্বর সওজ’র পক্ষ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে শাহ আমানত সেতুর উভয় পাশে সওজের অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে অবৈধভাবে নির্মিত দোকান, স্থাপনা, গাড়ি পার্কিং এবং দখলকারীদের ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাকলিয়া বস্তি :
নদীর তীর দখল করে বাকলিয়া ক্ষেতচর এলাকায় গড়ে ওঠেছে নানা স্থাপনা। বস্তিঘর থেকে শুরু করে বহুতল ভবন, গুদাম ডিপো, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নদী দখলের তালিকায় রয়েছে হতদরিদ্র থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর নাম। নদীর চাক্তাই, রাজাখালী, বাকলিয়া এলাকায় বেশি দখল হয়েছে। এসব এলাকায় নদীর তীর দখল করে অন্তত ৭ হাজার বস্তিঘর রয়েছে। বস্তিঘর ছাড়াও শুঁটকি আড়ত, মাছের খামার, মসজিদ, মন্দির, স্কুলসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পের মাটি ভরাট করে এই বস্তি গড়ে ওঠেছে। ২০১১ সালে কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং কাজ শুরু হয়।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন :
২০১৫ সালে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগ বাকলিয়া বাস্তুহারা ও শাহ আমানত সেতু এলাকায় দখলদারের পরিমাপ করে। তৎকালীন সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সামিউল মাসুদ প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমি অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৫০ দশমিক ৬৪০০ একর সরকারি ভূমি নিয়ে মামলা আছে। বাকি ভূমি নিয়ে মামলা নেই। স্থানীয়ভাবে ১৫৮ একর ভূমির মূল্য দুই হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বলে জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দখল করা জমিতে কাঁচা ঘর, দোকান, ভবন, বালুর স্তূপ, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, মৎস্য প্রকল্প, জসিম উদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়, সৎসঙ্গ বিহার, দাতব্য চিকিৎসালয়, প্লাস্টিক ও বোতল কারখানা এবং মুরগির খামার গড়ে তোলা হয়েছে।
উচ্ছেদ কার্যক্রম :
হাইকোর্টের নির্দেশে জেলা প্রশাসন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছিল। সদরঘাট, মাঝিরঘাট এলাকায় দুই দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এরপর বন্ধ হয়ে যায় উচ্ছেদ কার্যক্রম। বন্দর কর্তৃপক্ষও লালদিয়ার চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। দুই বছর ধরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। থেকে থেকে চলছে উচ্ছেদ কার্যক্রম।
দেখা যায়, সদরঘাট ও মাঝিরঘাট এলাকায় উচ্ছেদ করা জায়গা ফের বেদখল হয়ে গেছে। উচ্ছেদের পর তা সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় ফের বেদখলে চলে যাচ্ছে।
মাছ বাজার :
কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই-রাজাখালী খালের মোহনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে ইজারা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। তারপাশে নির্মাণ করা হয়েছে হিমাগার ও বরফকল। রাজাখালী খালের তীরে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। আইন-কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে নির্মাণ করা প্রায় শেষ করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ৯০ দিনের মধ্যে দুই হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায় দেন আদালত। হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট