চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

যেন একই ফ্রেমে ২৫ শিশুর ভাগ্য

স্বজন ছাড়াই কাটে ওদের ঈদ

মোহাম্মদ আলী

৪ জুন, ২০১৯ | ২:৪০ পূর্বাহ্ণ

দরজার গ্রিল ধরে অনাথ শিশুগুলো অপলক দৃষ্টিতে বাইরের পানে তাকিয়ে থাকে। এ বুঝি তাদের স্বজন আসছে। আদর করে বুকে তুলে নিবে। এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, আসে মাস। কিন্তু তাদের অপেক্ষা ফুরোয় না। স্বজনও আসে না। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে চার দেওয়ালের ভিতরে এভাবে কাটছে তাদের জীবন। নগরীর রৌফাবাদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘ছোটমণি নিবাসে’ ২৫ অনাথ শিশুর জীবনের বাস্তব চিত্র এটি। ভাগ্য বিড়ম্বিত তাসফিয়া, মুক্তা, আরিফ, আরাফাত, মিনহাজ, মেহেদীসহ ২৫ শিশুর জীবনের গল্প এক ও অভিন্ন। তারা হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু। তাদের ঠাঁই হয়েছে এই ‘ছোটমণি নিবাসে’। প্রতিনিয়ত চাপা কষ্টের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই শিশুগুলোর কষ্ট ঈদ এলে আরো বেড়ে যায়। স্বজন ছাড়াই কাটে তাদের ঈদ। এমনকি স্বজন ছাড়া থাকতে থাকতে এদের অনেকে ঈদ কি তাও বুঝে না।
ছোটমণি নিবাসের এক একটি শিশুর দুঃখগাঁথা জীবনের ইতিহাস সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে। আনুমানিক আড়াই বছর বয়সের শিশু তাসফিয়া আক্তারকে খুঁজে পায় জিআরপি থানা পুলিশ। থানায় জিডি করে তাকে তোলা হয় আদালতে। আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাকে প্রেরণ করা হয় ছোটমণি নিবাসে। এরপর সেখানে তার বেড়ে ওঠা। শিশু তাসফিয়া জানে না তার মা-বাবার পরিচয় কিংবা বাড়ির ঠিকানা। ছোটমণি নিবাসে ঠাঁই হওয়া তাসফিয়া গত ৬ মাস ধরে স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আগন্তুক দেখলে বড় আশা নিয়ে ছুটে আসে। এ বুঝি তার স্বজন এসেছে। কিন্তু পরক্ষণে তা মিইয়ে যায়। কষ্টে নীরবে অশ্রু ঝড়ে। আনুমানিক তিন বছরের এ শিশুকে মা-বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর অবুঝ শিশুটি
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুই যেন তার নীরব অভিব্যক্তি, এই পৃথিবীতে সে বড় অসহায়। মা-বাবার আদর কপালে জুটেনি। হয়নি দেখার সুযোগও। ভবিষ্যতে দেখা হবে কিনা তারও নেই কোনো নিশ্চয়তা। যেন তার নিয়তিতে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃখগাঁথা।
ছোটমণি নিবাসে বর্তমানে সর্বকনিষ্ঠ বাসিন্দা আরিফ আবরার। আনুমানিক দেড় বছরের এ শিশুটি প্রতিনিয়ত মা-মা বলে খুঁজে বেড়ায়। ছোটমণি নিবাসের রেজিস্টার থেকে জানা যায়, জন্মের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি হয়ে যায় শিশু আবরার। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর তার ঠিকানা হয় ছোটমণি নিবাসে। আরিফের মতো আরেক অসহায় শিশু আরাফাতের জীবনের গল্পও একই। জন্মের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ফেলে যায় স্বজনরা। এরপর হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলার পর আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের ২২ মার্চ তার ঠিকানা হয় ছোটমণি নিবাসে। এখন সেখানে কাটছে তার স্বজনহীন কষ্টের জীবন।
তাসফিয়া, আরিফ আবরার ও আরাফাতের জীবনের মতো মুক্তা, মিনহাজ, মেহেদীসহ ২৫ শিশুর জীবনের ভাগ্য যেন একই ফ্রেমে বন্দী। পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া এ শিশুগুলো স্বজনের খোঁজে প্রতিনিয়ত। ঈদ আসলে তাদের চাপা কষ্ট পরিণত হয় দীর্ঘশ্বাসে। ভাগ্য বিড়ম্বিত বলে সেই কষ্ট কখনো গুছে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট