চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

‘স্লিপ বাণিজ্যে’ অর্ধশত দালাল চমেক হাসপাতালে

ইমাম হোসাইন রাজু

১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১:৩০ অপরাহ্ণ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত স্বামীকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন হাজেরা বেগম। চিকিৎসকের দেয়া প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ কিনতে ছুটতে শুরু করলে সহযোগিতা করতে হাজির এক যুবক। ওষুধগুলো কম দামে কিনে দেয়ার আশ্বাসে হাজেরাকে নিয়ে যায় হাসপাতালের পূর্ব গেটের একটি ফার্মেসিতে। বিপদ আর সরলতাকে পুঁজি করে চার হাজার টাকার ওষুধও কিনে দেন তাকে। যদিও একই ওষুধ পরবর্তীতে অন্য আরেকটি ফার্মেসিতে কিনেছেন মাত্র এক হাজার টাকায়। হাজেরার বুঝতে বাকি নেই, তিনি দালালের খপ্পড়ে পড়েছেন।

দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রায় অর্ধশত দালাল নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চলছে এ ওষুধ বাণিজ্য। একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট এ অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে থাকার পরও লাগাম টানার উদ্যোগ নেয়নি কেউই। যদিও হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক বিষয়টি নিয়ে নজরে আছে জানিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। বিপরীতে ফার্মেসি সমিতির পক্ষ থেকে ‘মানবতার’ কাজ করতে গিয়ে দালাল আখ্যায়িত করছেন বলে দাবি করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে এমন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটটি। যার জন্য হাসপাতালের পূর্ব গেটের ২৫টি ফার্মেসি দোকান থেকে মাসোহারাও নিচ্ছেন এসব ব্যক্তি ও সংগঠন। এ সুযোগে সাধারণ রোগীদের পকেট কাটায় মাতোয়ারা স্লিপ বাণিজ্যে জড়িত অর্ধশত দালাল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেটে ২৫টি ফার্মেসি দোকান রয়েছে। এসব ফার্মেসির হয়ে হাসপাতালেরর বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাজ করেন প্রায় অর্ধশত দালাল। যাদের ডাকা হয় ‘স্লিপ ম্যান’ নামে। মূলত এসব দালালের কাজ হচ্ছে জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের নির্দিষ্ট ফার্মেসিতে নিয়ে যাওয়া। যার জন্য ফার্মেসি থেকে প্রতি প্রেসক্রিপশন বা স্লিপে বরাদ্দ ১০ শতাংশ কমিশনও। সুযোগে কিছু কিছু ফার্মেসিও কয়েকগুণ বেশি দাম হাতিয়ে নেয় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে। অন্যদিকে, প্রতিটি ওয়ার্ডে হাসপাতালের কিছু কর্মচারীদের সহযোগিতায় দেদারসে কাজ চালিয়ে নেয় এসব স্লিপ ম্যান। যার জন্য কমিশনের একটি অংশও যায় কর্মচারীর পকেটে। যাদের কাজ হচ্ছে রোগীর স্বজনদের স্লিপ ম্যানকে পরিচয় করে দেয়া এবং ঝামেলায় পড়লে হাসপাতালের লোক বলে চালিয়ে নেয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্মেসি দোকান মালিক বিষয়টি স্বীকার করে পূর্বকোণকে বলেন, ‘কিছু কিছু ম্যান আছে, যাদের মাসিক বেতন দেয়া হয়। তবে বেশি অংশই কমিশনে কাজ করে। প্রতিটি স্লিপ থেকে তাদের ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। আবার কেউ কেউ নির্ধারিত দামের চেয়ে দুই-তিনগুণ বেশি দামও নিয়ে থাকে।’
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :
এসব বিষয়ে পাঁচলাইশ থানা ফার্মেসি দোকান মালিক সমিতির সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকির কাছে জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘পূর্ব গেটে দোকান অনেক বেশি। যে দোকানগুলো ভেতরে, তারা দুই-একজন করে কর্মচারী রেখেছেন। তারা কিছুকিছু কাজ করে থাকে। আবার দেখা যায়, পরিচিত কেউ এসে বলে, ওমুক ওয়ার্ডে আমার রোগী আছে- ওষুধ পাঠিয়ে দিন। মানবতা হিসেবে কর্মচারী দিয়ে পাঠানো হয়। তাই বলে তারাতো আর দালাল নয়। এমন হলেতো মানবতার কাজও বন্ধ করে দিতে হবে।’

এদিকে, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে স্লিপ বাণিজ্যের বিষয়টি নজরে আছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর পূর্বকোণকে বলেন, ‘চক্রটির বিষয়ে নজর রাখা হয়েছে। তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। শনাক্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে এ বাণিজ্য বন্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
যে ফার্মেসির হয়ে কাজ করেন যারা :

সজীব ফার্মেসির হয়ে সজল, ফরিদ, নিশাদ ফার্মেসির হয়ে আশিক, নোভা ফার্মেসির হয়ে নুর হোসেন, পলাশ, লাজ ফার্মেসির হয়ে সেলিম, হারুন, ফেনী ফার্মেসির হয়ে হানিফ, মীরু, অর্ক ফার্মেসির হয়ে সালাউদ্দিন, নয়ন, তাহা ফার্মেসির হয়ে রাজু, লিটন, সিকদার ফার্মেসির হয়ে রয়েল, মিন্টু, দুলাল, জনতা ফার্মেসির হয়ে জিকু, বাবু, সানন্দা ফার্মেসির হয়ে ওয়াসিম, রিনা ফার্মেসির সঞ্চয়, নিতাই, হীরা ফার্মেসিতে স্বপন, উত্তম, মিলন, ন্যাশনাল ফার্মেসিতে উত্তম, তপন, নিতাই, জয় ফার্মেসির হয়ে রুবেল, উত্তম, মেডিসিন ফার্মেসির হয়ে নিলয়, মিতুল, ইরানী, একুশে ফার্মেসির হয়ে বাবু, সজীব, জাহাঙ্গীর, রাঙ্গুনিয়া ফার্মেসির হয়ে রাসেল, সুমন, এমদাদ, জসিম, লোটাস ফার্মেসির হয়ে জাহাঙ্গীর, বাবু, সুমন ড্রাগ ফার্মেসির হয়ে তপন, ওমর, জয়নব ফার্মেসির হয়ে কার্তিক, ফারুক, সাহান ফার্মেসির হয়ে নুনু বাবু, নিমাই, সবুজ ফার্মেসির হয়ে জসিম, আনোয়ার, সুমন, সাহা ফার্মেসির স্বয়ন, বি কে ফার্মেসির হয়ে উৎপল, সুমন, সবুজ এবং সিটি ফার্মেসির হয়ে শাহাজান, ফারুক, সাইফুল নামে এসব দালাল কাজ করে থাকেন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট