চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সাংসদ মোস্তাফিজকে নিয়ে বিব্রত দল

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৬ আগস্ট, ২০২০ | ১:১২ অপরাহ্ণ

বার বার ‘বিতর্কিত’ ঘটনার কারণে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এখন সমালোচনা তুঙ্গে। দলও তাঁর কর্মকান্ড নিয়ে বিব্রত। গত সোমবার নগরীর জামালখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ ও মানববন্ধনে তাঁর অনুসারীদের হামলার ঘটনায় সর্বত্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এরপর এখন সমালোচনার তুঙ্গে তিনি। সাংসদের এসব নেতিবাচক কর্মকান্ডে বিব্রত আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রধান-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁর নেতিবাচক কর্মকান্ড জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে দলটি।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, মোস্তাফিজুর রহমান বাঁশখালী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমেই বিরোধে জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক গুরু সুলতানুল কবির চৌধুরীর (প্রয়াত) সঙ্গে। এরপর নির্বাচন কর্মকর্তাকে পেটানো, দলের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়ম, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা ও বিরুদ্ধাচারণকারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বার বার বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে আসছেন তিনি। এতে দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিব্রত।

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের এসব ঘটনা দলের জন্য বিব্রতকর। এর ব্যবস্থা নিতে গত সোমবার দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওরায়দুল কাদেরের কাছে আমি মেসেজ দিয়েছি। এছাড়াও দলের সভায় বিষয়টি উত্থানপন করব।’

এমপি মোস্তাফিজকে দলে অনুপ্রবেশকারী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অর্বাচীন পলিটিশিয়ানদের রাজনীতিতে আনলে তারা রাজনীতিকে কলুষিত করবেন। তিনি এক সময় জাতীয় পার্টি করতেন, এখনো জাতীয় পার্টির গন্ধ যায়নি।’
গত সোম ও মঙ্গলবার দুদিন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি সাঈদীপুত্র শামীম বিন সাঈদীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এমপি’র পোস্টার-ব্যানার সাঁটানো হয়েছিল। অবশ্য সমালোচনার পর সেই অনুষ্ঠানে যাননি তিনি।

২০১৬ সালের ১ জুন ইউপি নির্বাচনে পছন্দের ব্যক্তির নির্বাচনী কাজে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন এমপি মোস্তাফিজ। তা করতে না পেরে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল কবিরকে মারধর করার অভিযোগ ওঠেছিল। ৪ জুন এমপি মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম। তিনি এখন রাঙামাটি সদর উপজেলা কার্যালয়ে কর্মরত। গতকাল পূর্বকোণকে তিনি বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে আমার সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন এমপি মোস্তাফিজুর রহমান।’

২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভায় তাঁর বিরুদ্ধে জামায়াত-প্রীতির অভিযোগ তোলেন জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও আওয়ামী লীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট মুজিবুল হক। এসময় মুজিবুল হককে জুতা নিয়ে তেড়ে যান এমপি মোস্তাফিজ।

এডভোকেট মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আ. লীগের বর্ধিত সভায় ন্যক্কারজনকভাবে তেড়ে এসেছিল। তাঁরমধ্যে ন্যূনতম ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলার ঘটনায় বাঁশখালীর মানুষ হিসেবে আমরা মর্মাহত।

জামায়াত-প্রীতির অভিযোগ : বাঁশখালী উপজেলা জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ঘটনায় নারকীয় তান্ডব চালিয়েছিল বাঁশখালীতে। জাতীয় দিবসে জামায়াত নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক প্রদান, জামায়াত ঘরনার লোককে কাজি নিয়োগসহ জামায়াত-প্রীতির অভিযোগ রয়েছে সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। কাজি নিয়োগে জামায়াত ঘরনার লোককে সুপারিশ করার বিষয়টি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর হামলার অভিযোগ : ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির চৌধুরীকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। শেষে দলীয় প্রার্থী পরিবর্তন করে মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রার্থী করা হয়। সেই থেকে মোস্তাফিজ-লিটনের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। বিভিন্ন সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের লেগেই ছিল।
২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ নেতাদের লিটনের অনুসারীদের উপর গুলি ছোড়ার অভিযোগ ওঠেছিল। দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর গুলি বর্ষণের ঘটনায় এমপির বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছিলেন লিটন। তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
দলের সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে কটূক্তি : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক-সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে মোবাইলে কটূক্তি করেছেন সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান। দাম্ভিকতাপূর্ণ সেই কটূক্তির রেকর্ড ভাইরাল হয়েছিল।
পৌর মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরীর সাথে বিরোধে জড়ান তিনি। বিজয় মেলার অনুষ্ঠান নিয়ে মেয়রকে একহাত নেন সাংসদ মোস্তাফিজ। এমপি-মেয়রের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। মেয়রের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় পৌর মেয়র থানায় জিডি করেছিলেন। এছাড়াও মেয়রের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এমপি’র কারসাজির অভিযোগ ছিল। মেয়র চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করেছিলেন। বর্তমানে পৌর মেয়রের সাথে এমপির মধুর সম্পর্ক। মেয়র সেলিমুল হক চৌধুরী নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পৌর মেয়র সেলিমুল হকের মোবাইল বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে ৩০ নভেম্বর চাম্বলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাহমুদুল ইসলামের জনসভায প্রকাশ্যে গুলি বর্ষণ করা হয়। এমপি অনুসারীরা গুলি ছুড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চাম্বল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক সিকদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
জাপা’র কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সাংসদ মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘জনগণের ম্যান্ডেড ছাড়া জনপ্রতিনিধি হলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি সবসময় জনগণের কাছে করজোড় থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার গায়ে হাত তোলা মানে দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধার গায়ে হাত তোলা সামিল।’
উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করার অভিযোগ রয়েছে এমপি’র বিরুদ্ধে। দলীয় প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরও নানাভাবে অসহযোগিতার অভিযোগ আছে।
মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে হামলা : গত ২৬ জুলাই মারা যান মুক্তিযোদ্ধা ডা. আশরাফ আলী। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী মৌলভী সৈয়দের বড় ভাই। তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়নি। প্রশাসনের গাফিলতির চেয়ে এমপি’র নেপথ্যকে দায়ী করেছেন তাঁর পরিবার। এছাড়াও পরদিন ‘বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি’ বলে গণমাধ্যমে মন্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড আন্দোলনে নামে। গত ৩ আগস্ট বাঁশখালীর পুঁইছড়িতে মানববন্ধন কর্মসূচিতে হামলা চালানো হয়। এমপির বিরুদ্ধে মানববন্ধনে যুক্ত থাকার অভিযোগে সাংবাদিক ফারুক আবদল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। নাদিম নামে এক যুবলীগকর্মী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করেন।
সর্বশেষ গত সোমবার নগরীর জামালখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশেও হামলা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে হামলার ঘটনায় সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানকে দায়ী করে আসছেন মুক্তিযোদ্ধা ও সন্তান কমান্ড। এ ঘটনার পর সারাদেশে এখন এমপি মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবারও প্রতিবাদ সভা করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট