চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

খাদ্যে রাসায়নিক সন্ত্রাস : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মজুমদার

৩ জুন, ২০১৯ | ১:৪০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে ‘নিরাপদ খাদ্য’ অন্যতম। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে মৌলিক উপকরণ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে খাদ্যকে জীবনের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্ত খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে, তৈরি অথবা কাঁচা খাদ্য কোনোটির ওপরই মানুষ আর আস্থা রাখতে পারছে না। একশ্রেণির মুনাফালোভী মানুষ প্রতিযোগিতামূলক ভাবে এ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। প্রকাশ্যে-গোপনে খাদ্যে মিশাচ্ছে বিষ। এ বিষযুক্ত খাবার খেয়ে মানুষ ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পুরো জাতি এখন সংকটের মুখোমুখি। জঙ্গিবাদ, মাদকের ন্যায় এটিও এখন জাতীয় সমস্যা। গ্রাম থেকে নগর, সব মানুষ নিরাপদ খাদ্য নিয়ে শঙ্কিত। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন সাধারণ মানুষ। যা সন্ত্রাসের নামান্তর।
‘সন্ত্রাস’এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, অতিশয় ভয় ও শঙ্কা। যদি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি নিজের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে আইন বিরুদ্ধ, অনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে অন্যের জীবনকে অনিরাপদ করে তুলে তখন তাকে ‘সন্ত্রাস’ বলে অবহিত করা হয়। সেক্ষেত্রে খাবারে রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণও এক ধরনের ‘সন্ত্রাস’। খাবারে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি রোগব্যাধির মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ অকেজো করে বা প্রাণহানি ঘটায় এটি হচ্ছে ‘খাদ্যে রাসায়নিক সন্ত্রাস’।
খাদ্যে ভেজাল শুধু ধর্মীয় অপরাধ নয়; এটি নৈতিকতা ও মানবতা বিরোধীও। দেশের প্রচলিত আইনেও খাদ্যে ভেজাল বা রাসানিক মিশ্রণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারপরও বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। তারা আল্লাহর আদেশ, দেশের আইন, নৈতিকতা, মানবতার তোয়াক্কা করে না। তাদের চাই শুধু মুনাফা! চক্রাকার পদ্ধতিতে একজন বিষ মিশাচ্ছে, অন্যজন কিনে খাচ্ছে। শুধু সাধারণ ভোক্তা নয়, আড়তদার বা বিক্রেতাও কখনো ভোক্তা হয়ে কোন না কোন খাদ্যদ্রব্য নিজের বা পরিবার পরিজনের জন্য কিনছে। সেক্ষেত্রে তিনি ও তার পরিবার পরিজনও রাসায়নিক বিষ মিশ্রিত খাদ্য খাচ্ছেন। সমগ্র বিশ্বেই খাদ্যে রাসায়নিক মেশানো ও ভেজাল প্রবণতা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই প্রবণতা অনেক বেশি। বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদন দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা ২০১৫ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছয় হাজার ৩৬০টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন। তারা সেগুলো মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএস) ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সংগৃহীত ওই নমুনার মধ্যে এক হাজার ৯৭৮টিতে, অর্থাৎ ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ খাদ্যপণ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, চালে ৪. ৫ শতাংশ, ডাল ও ছোলায় ৩.৭ শতাংশ, আটা, গম ও ভুট্টায় ২.২ শতাংশ, সুজিতে ১০.৪ শতাংশ, বেসনে ২২.৮ শতাংশ, সেমাইতে ৬৮.৫ শতাংশ , হলুদে ২৭.৭ শতাংশ, মরিচে ৪৪.৫ শতাংশ, ধনিয়ায় ৪৭.৬ শতাংশ, জিরায় ২ শতাংশ, গরম মসলায় ২০ শতাংশ, সরিষার তেলে ৩০.৭ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৬৮ শতাংশ, পামতেলে ৪৪.৫ শতাংশ, নারিকেল তেল বা অলিভ অয়েলে ৩.৫ শতাংশ, চা-পাতায় ২.১ শতাংশ, চিনিতে ১.৩ শতাংশ, গুড়ে ৭২.৬ শতাংশ, মধুতে ৬৬.৭ শতাংশ, ড্রিংকসে ৩.৬ শতাংশ, চাটনি বা আচারে ৩৩.৩ শতাংশ, জুসে ১০.৫ শতাংশ, লবণে ২৫.২ শতাংশ, শুঁটকিতে ২০ শতাংশ, তরল দুধে ২০ শতাংশ, মিষ্টিতে ৯৬ শতাংশ, ঘিতে ৫০ শতাংশ, বিস্কুটে ২৫.৯ শতাংশ, চকলেট বা লজেন্সে ৬৩.৬ শতাংশ ভেজাল ও রাসায়নিক উপাদান রয়েছে।
কী খাচ্ছি আমরা ?
বাংলাদেশে খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থ মিশানোর প্রবণতা গাণিতিক হারে বাড়ছে। খাদ্যের উৎস স্থান থেকে পরিবহন ও বাজারজাতের সময় রাসায়নিক মেশানো হয়। শাক-সবজি-ফল’এ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাচ্ছে, যা কলেরা ও ডায়রিয়ার জীবাণু বহন করে। বিশেষ করে শশা ও কাঁচা মরিচ, টমাটো, সালাদের বিভিন্ন উপকরণ বেশি বিপদজ্জনক। কারণ, এগুলো মানুষ খুব বেশি ধুয়ে খায় না। কাঁচা খায়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মাছ ও মূল আমিষের উৎস ডিম-মুরগিও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। পোল্ট্রিতে খাওয়ানো হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্য। একই বর্জ্য খাওয়ানো হচ্ছে খামারের মাছকে। আবার পোল্ট্রি মুরগির বর্জ্য জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফল পাকাতে যে বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় তার নাম ‘ক্যালসিয়াম কার্বাইড’। এক কেজি কার্বাইডের মূল্য ৬০ টাকা। যা দিয়ে ১০ টন ফল পাকানো সম্ভব। এ হিসেবে ৫০ কেজি ফল পাকাতে মাত্র ৫ গ্রাম কার্বাইড প্রয়োজন। অথচ পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৫০ কেজি ফল পাকাতে ব্যবহার করেন ১০০ গ্রাম-এর বেশি কার্বাইড। ‘ইথাইলিন’ বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগের কারণে ২-৪ দিনের মধ্যেই ফল হলুদ রঙ ধারণ করে। বাস্তবে এসব ফল বাইরে পাকা মনে হলেও এর ভেতরের অংশে অপরিপক্ব থেকেই যায়। ফল দ্রুত পাকাতে ‘ইসরিল’ নামের এক ধরনের হরমোন স্প্রে করা হয়। অতিরিক্ত ইসরিল স্প্রে করায় ফল ও সবজি বিষাক্ত হয়ে পড়ে।
খাদ্যে রাসায়নিক সন্ত্রাসের সবচেয়ে আলোচিত নাম ‘ফরমালিন’। ফরমালিনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো জীবাণু নাশ করা। ছত্রাক, ব্যকটেরিয়াসহ যে কোন ধরনের জীবাণুকে দ্রুত মেরে ফেলতে পারে ফরমালিন। মাছ তাজা রাখতে যে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় তা আসলে মরদেহ সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা হয়। অথচ, ফরমালিনই ছিটানো হয় শাক-সবজি ও মাছে।
হাট-বাজার, অভিজাত চেইন সপ – কোথাও রাসায়নিকমুক্ত মাছ পাওয়া যায় না। ৮৫ শতাংশ মাছেই বরফের সঙ্গে বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো হয়। কেচকি-লইট্যা থেকে রুই-কাতাল কোনটাই বাদ যাচ্ছে না। শুধু ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতেই মাছের মতো আমিষ জাতীয় খাদ্যেকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হয়। চিংড়িতে ফরমালিনের পাশাপাশি ওজন বৃদ্ধির জন্য দেয়া হচ্ছে জেলি! পাইকারি আড়তগুলোতে মাছের স্তূপ দিয়ে তার ওপর প্রকাশ্যেই ফরমালিন মিশ্রিত পানি ছিটানো হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, আড়তগুলো ফরমালিন মিশ্রিত বরফ দ্বারা মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করছে অভিনব স্টাইলে। এক্ষেত্রে ফরমালিন মেশানো পানি দিয়েই বরফের পাটা বানানো হয়। সেই ফরমালিন বরফের মধ্যেই চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ। সে কারণে মাছের বাজারে মাছি দেখা যায় না!
যত্রতত্র গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বেকারি ও মিষ্টি জাতীয় খাদ্য প্রস্তত করার কারখানা। পর্যাপ্ত আলোবাতাসের ব্যবস্থা নেই। গরমে ঘামে চুপসানো, খালি গায়ে বেকারি খাদ্য ও মিষ্টি প্রস্তুতকারী শ্রমিকরা আটা-ময়দা দলিত মথিত করে। প্রতিটি কারখানার ভেতরে-বাইরে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। মশা-মাছির ভনভন আর একাধিক কাঁচা-পাকা টয়লেটের অবস্থান। সেখানেই তৈরি হয় ব্রেড, বিস্কুট, সেমাই, কেকসহ নানা লোভনীয় খাদ্যপণ্য। উৎপাদন ব্যয় কমাতে এসব বেকারির খাদ্যপণ্যে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পচা ডিমসহ নিম্মমানের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ট্যালো, ফ্যাটি এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সটাইল রঙসহ নানা রাসায়নিকও ব্যবহার করতে দেখা যায়। অবিক্রীত নষ্ট হওয়া মিষ্টি ফেলে দেয়া হয় না। গরম সিরায় চুবিয়ে আবার বিক্রি করা হয়।
এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন ও বোতলজাতের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে; অটো মেশিনে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্ধারিত ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল উপকরণগুলো ফুটিয়ে নিয়ে তা রিফাইন করার মাধ্যমে সংমিশ্রণ ঘটানো। বোতলজাত করা থেকে মুখ লাগানো পর্যন্ত সবকিছুই অটো মেশিনে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু কথিত জুস কারখানাগুলোতে সবকিছুই চালানো হচ্ছে হাতুড়ে পদ্ধতিতে। মেশানো হচ্ছে, প্রিজারভেটিভ। ফলের কোন চিহ্নই নেই; আছে শুধু রাসায়নিক নির্যাস। এসব এনার্জি ড্রিংক এক ধরনের তরল বিষ!
মসলার রঙ আকর্ষণীয় করতে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক রঙয়ের পাশাপাশি কাপড়ে ব্যবহৃত বিষাক্ত রঙ, ইটের গুঁড়া মেশাচ্ছে মরিচের সঙ্গে। হলুদে দেয়া হচ্ছে মটর ডাল, ধনিয়ায় স’মিলের কাঠের গুঁড়া ও পোস্তাদানায় মেশানো হচ্ছে সুজি। মসলার ওজন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ধানের ভুসি।
মুড়ি, চাল ভাজার রূপান্তর। আদিকাল থেকে গ্রাম থেকে নগরে লোকজনের কাছে পরিচিতি একটি নাম। চিকিৎসকরা প্রায় মুড়ি খাওয়ার পরার্মশ দেন; বিশেষ করে ডায়বেটিক রোগে আক্রান্তদের। মুড়িতে লবণের বদলে মেশানো হচ্ছে ফসল উৎপাদনের সেই ইউরিয়া সার। এতে মুড়ির ওজন যেমন বেড়ে যায়, ফুলকো ও ধবধবে সাদা হয়।
দুধ উৎপাদন করতে কোনো গাভীর প্রয়োজন পড়ে না, কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয় না গবাদি পশুর খামারও। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হচ্ছে এমন ‘বিষ’। পরে ‘খাঁটি দুধ’ হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে সারাদেশে। আসলে নকল দুধ তৈরিতে ছানার ফেলনা পানি, খাবার পানি, থাইসোডা, পার অক্সাইড, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কাটিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস দেয়া হয়। পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে সহজেই নকল দুধ তৈরি করা যায়। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন।
জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’। এটিও নিরাপদ থাকছে না। যত্রতত্র কারখানা বানিয়ে ওয়াসা ও নলকুপের পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই বিশুদ্ধ ‘ড্রিংকিং ওয়াটার’ বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পানিকে বিশুদ্ধ করলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি ছেকে বড় প্লাস্টিক জার ভরে বাজারজাত করছে।
খাদ্যে রাসায়নিক ও দূষিত পানির কারণেই বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের পানিবাহিত রোগ, ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন আগামী ২০ বছরের মধ্যে মানুষের মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কারণ হবে খাদ্যে রাসায়নিক সন্ত্রাস।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে। যা ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। এই আইনের আওতায় ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করাই হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। একটা সময় শুধু প্রচার আর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করাই ছিলো নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম। আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাচে পড়ে সংস্থাটি মাঠ পর্যায়ে কোন অভিযান পরিচালনা করতে পারে নি। ২০১৮ সালে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট পায় (বিএফএসএ)। মাত্র তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা শহরে বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযানে নামে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে সংস্থাটি। তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। লোকবল নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। অবাক বিষয় হচ্ছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকারি এ সংস্থটি ঢাকা ছাড়া দেশের অন্য কোথাও এটি শাখাও খুলতে পারে নি। ফলে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখনও শুধু শ্লোগানের মধ্য সীমাবদ্ধ রয়েছে।
আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েও খাদ্যে রাসায়নিক মিশ্রণের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। এ প্রেক্ষাপটে র‌্যাব এর মহাপরিচালক, খাদ্যমন্ত্রী, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে চলমান আইন সংশোধন করে মৃত্যুদ- প্রদান করার প্রস্তাব করেছেন। খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক মেশানো ঠেকাতে হাইকোর্ট ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ অবলম্বন করার নির্দেশনা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫২টি খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত, উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে হাইকোর্ট। বিএসটিআই বাতিল ও স্থগিত করেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সনদ। জেল-জরিমানা তো আছেই। তবুও থামছে না খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ ও নোংরা পরিবেশে খাদ্য উৎপাদন-সংরক্ষণ। জাতীয় এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে দুর্নীতি দমন কমিশনের ন্যায় ক্ষমতায়ন করে সারাদেশে এর কার্যপরিধি বৃদ্ধি করা জরুরি।
আশার কথা হচ্ছে, বিগত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ঢাকাস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘নিরাপদ খাদ্য দিবস’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খাদ্যে ভেজাল দেয়া এক রকমের দুর্নীতি’। কাজেই ভেজালের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে, সেটি অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্যে ভেজাল দেয়া আমাদের দেশের কিছু ব্যবসায়ীর চরিত্রগত বদঅভ্যাস। এটি বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ খাদ্যের বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু তার একার পক্ষে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দেশের সব শ্রেণিই পেশার মানুষকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বন্ধ হবে ‘খাদ্যে রাসায়নিক সন্ত্রাস, হবে নিরাপদ খাদ্যের বাংলাদেশ’।

লেখক: সম্পাদক, বাংলদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট