‘তিন মাসের বেশি সময় বাসায় ছিলাম। একটু বারান্দায় গিয়ে বসতে পারলেও দরজার বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় নি। কিন্তু এভাবে আর কত দিন থাকা যায়?’ করোনারকালে বন্দীদশার এমন বর্ণনা দিলেন কলেজ শিক্ষার্থী তাসনুভা। তাই বাসা থেকে বেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে নগরীর কাজীর দেউরি স্টেডিয়াম এলাকায় বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মাতোয়ারা এ শিক্ষার্থী। কিন্তু করোনার এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিয়ে তাদের যেন কোন ভাবনাই নেই। ৮/১০ জন বন্ধুর মধ্যে তিনজনের মুখেই দেখা যায়নি মাস্ক। সামাজিক দূরত্ব কি সেটাও যেন তাদের জানা নেই।
শুধু তারাই নয়, এমন চিত্র নগরজুড়েই। চট্টগ্রামে আক্রান্তের ৭০ শতাংশই এই নগরীতে। যেখানে জ্যামিতিক হারে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও এখনও মানুষের আচার-আচরণে নেই কোন পরিবর্তন। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে অনেকেই ভিড় ঠেলে স্বাভাবিক চলাচল করছেন। হাটবাজার রাস্তাঘাট থেকে বাসস্ট্যান্ড, সবখানেই মানুষের উপচে পড়া ভিড়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে, বিপণি বিতানগুলোর সামনে দল বেঁধে আড্ডা দিচ্ছেন তরুণেরা। এ অবস্থায় করোনার ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কাও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন উদাসীনতায় সামনের দিনগুলো করোনা আরও বেশি ভয়ংকর হতে পারে।
এদিকে, আড্ডা কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকারিভাবে নিদের্শনা থাকলেও তা মানার বালাই যেন দেখা যায়না শহরে। মাস্ক পরিধান না করার বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা থাকলেও এ নিয়ে পদক্ষেপ নেয়াতেও প্রশাসনের যেন ঢিলেঢালা মনোভাব। এছাড়া সংক্রমণ শুরুর দিকে সবার মাঝে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানার যে প্রবণতা ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেই প্রবণতা বাড়ার চেয়ে হ্রাসই পাচ্ছে দিনদিন। তাই শৃঙ্খল ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনকেও আরও বেশি কঠোর হওয়ার পরামর্শ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। আর মানুষের চলাচল ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা না গেলে সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে বলেও অভিমত তাঁদের।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি পূর্বকোণকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সিংহভাগই সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হয়েছেন। যদিও নিজ থেকেই আমরা সচেতন না হই, তাহলে এ সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন। প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া উচিত নয়। আর বাইরে আসতে হলে অবশ্যই মাস্ক পড়তে হবে। মাস্কের বিকল্প কিছুই নেই। একই সাথে স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে। তা না হলে সামনে দিন আরও খারাপের দিতে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার’।
তথ্য মতে, চট্টগ্রাম দেশের করোনাভাইরাসে এখনো দ্বিতীয় হটস্পট হিসেবে অবস্থা করছে। গেল এপ্রিল মাসে এ অঞ্চলে সংক্রমণ শনাক্তের পর থেকেই প্রতিদিনেই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সাথে মৃত্যুও। চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সিংহভাগই আক্রান্ত তরুণ ও যুবক ও মধ্যবয়সীরা। যাদের বয়স ২০ থেকে ৪০ এর মধ্যে। মোট আক্রান্তের প্রায় ৭০ শতাংশ এ বয়সীরা।
আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এ নিয়ে যেন সাধারণ মানুষের মধ্যে মাথা ব্যথা নেই। মূলত সবার মাঝেই এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করছে। রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, গণপরিবহনে সেই পূর্বের মত চলাচল করছে মানুষ। মাস্ক ছাড়াই অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহড়জুড়ে। যাদের আছে তাদের অনেকে তা মুখ থেকে নামানো। এমনকি ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লাভসটাও নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তাঘাটসহ যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। আর এসব যত্রতত্র পড়ে থাকা পরিত্যক্ত মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভ থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা চিকিৎসকদের ।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘মাস্ক না পরলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ৬ মাসের কারাদ-ে আইন আছে। কিন্তু তা কার্যকরে প্রশাসন পুরোপুরিই নিষ্ক্রিয়। রাস্তায় বের হলেই মানুষের ঢল। পাড়ায়, দোকানে, রাস্তার পাশে যুবকদের আড্ডা। এসব ঠেকাতে হবে। তা না হলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তাই এ বিষয়ে প্রশাসনকে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ এ বিশেষজ্ঞের।’ একই সাথে সাধারণ মানুষদের আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সংক্রমণ রোধে মানুষকে নিজ উদ্যোগে সচেতন হতে হবে। কারণ তিনি আক্রান্ত হলে তার পরিবারও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আর মানুষের আচার-আচরণে পরিবর্তন না হলে এর জন্য চরম মাশুল দিতে হবে।
পূর্বকোণ/এএ