চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আদালতে দুই আসামির স্বীকারোক্তি

সন্ত্রাসী দিয়ে মা-বোনকে হত্যা করে আমেরিকা প্রবাসী মাসুদ

নাজিম মুহাম্মদ

২৬ মে, ২০১৯ | ২:৩১ পূর্বাহ্ণ

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে নিজের বৃদ্ধা মা আর বোনকে হত্যা করে পানির ট্যাংকিতে লাশ ফেলে দিয়েছিলো মাসুদ। মা-বোনকে হত্যার পর ঘরের আলমিরায় থাকা ২০ লাখ টাকা লুটে নিয়ে ঘটনায় অংশ নেয়া আটজন মিলে ভাগভাটোয়ারা করে নেয়।
বাড়ির দলিল আর চেক বইয়ে স্বাক্ষর না করায় ভাগিনা মুশফিককে সাথে নিয়ে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে নিজের মা আর বোনেক হত্যা করে। সুদূর আমেরিকা থেকে এসে হত্যাকা- ঘটিয়ে ফের আমেরিকা চলে গেছে ঘাতক মাসুদ। পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনির এস এম শাহনেওয়াজের ছেলে হারুনর রশীদ মুন্না। তিনি নগর যুবলীগ নেতা (বহিষ্কৃত) সাইফুল আলম লিমনের অনুসারী। ঘটনার দশ মাসের মাথায় সহযোগী মাহফুজকে নিয়ে গত শুক্রবার বিকেলে মুন্না নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তারাই জানান, জমির দলিল ও নগদ টাকার লোভে আমেরিকা থেকে এসে মাসুদ তার মা ও বোনকে হত্যা করে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মিজানুর রহমান জানান, পরিকল্পিতভাবে মা-মেয়েকে খুন করা হয়েছে। জোড়াখুনের ঘটনায় আট থেকে দশজন জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছি আমরা। ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শুক্রবার মুন্না ও মাহফুজ নামের আরো দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুরো হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়ে গতকাল (শনিবার) মুন্না ও মাহফুজ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর আগে গ্রেপ্তার আরো তিনজন হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, সম্পত্তি ও টাকার লোভে আমেরিকা প্রবাসী মাসুদ নিজে উপস্থিত থেকে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে মা ও বোনকে হত্যা করেছে। গত বছরের ১৫ জুলাই রাতে নগরীর আমবাগানে নিজ বাসায় রূপালি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মেহেরুন্নেছা (৭৪) ও তার মা মনোয়ারা বেগমকে (৯৭) খুন করা হয়।
গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হারুনুর রশিদ মুন্না জানান, তার নিজ বাড়ি চাঁদপুরের তরপুচ-ি ইউনিয়নের নতুন সরকারবাড়িতে। নগরীর টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে থাকেন। মাসুদের ভাগিনা মুশফিকের সাথে তার ছোট বোনের প্রেম করে বিয়ে হয়। বিষয়টি তার ফুফু মেহেরুন্নেছা মেনে নেয়নি। মুশফিকের চাচা মাসুদ চার পাঁচ বছর ধরে আমেরিকায় থাকেন। ঘটনার আগের দিন বিকেল আনুমানিক দুইটায় (১৪ জুলাই ২০১৮) রেলওয়ের নিরাপত্তা রক্ষী (আরএনবি) সাহাবুদ্দিন, মুশফিক, আমেরিকা প্রবাসী মাসুদ, মুসলিম, জমি বিক্রির দালাল মাসুদসহ সবাই আমাবাগানের বাসায় বৈঠক করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বোন মেহেরুন্নেছার কাছ থেকে ভবনসহ জমি রেজিস্ট্রি করে নিবে। কাগজপত্র তৈরি হলে আরএনবি’র শাহাবউদ্দিন বাড়িসহ জমিটি তিন কোটি টাকায় কিনে নেবে। বিক্রির অর্ধেক টাকা মাসুদ ও বাকি অর্ধেক তার ভাগিনা মুশফিক নেবে। পুরো বিষয়টি তদারকি করার বিনিময়ে সন্ত্রাসী হারুনুর রশিদ মুন্না ও তার সহযোগিদের দশ লাখ টাকা দেয়া হবে। প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে বৈঠক সিদ্ধান্ত হয় দালাল মাসুদ জমির দলিল তৈরি করে আনবে। বোনের ভবন তৈরি থেকে জমি কেনা সবকিছুই মাসুদকে দিয়ে করিয়েছিলো সেই সুবাদে মেহেরুন্নেছার ঘরে কোথায় কি আছে সবকিছুই তার জানা। ঐ জমিটিও দালাল শাহাবুদ্দিন কিনে দিয়েছিলো।
মুন্না জানান, পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত (১৪ জুলাই ২০১৮) দিবাগত রাত প্রায় দেড়টার দিকে আমবাগান ফ্লোরাপাস রোডের বাসায় সামনে যায় তারা। ভবনের সামনে বেল গাছের নিচে মাসুদ, ভাগিনা মুশফিক জমি বিক্রির দালাল মাসুদ, আরএনবির সাহাবুদ্দিন, ও রাজমিস্ত্রি মুসলিম মাহফুজ জড়ো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুশফিক ও মাসুদ ঘরের দরজার কড়া নাড়লে মেহেরুন্নেছা দরজা খুলে মাসুদকে দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘তুই বিদেশ থেকে হঠাৎ দেশে কেন?। এরমধ্যে সবাই বাসার ভেতরে ঢুকে মেহেরুন্নেছাকে জমির দলিলে স্বাক্ষর করতে বলে। কিন্তু তিনি রাজি হয়নি। এ নিয়ে মাসুদের সাথে সত্তোরোর্ধ বোন মেহেরুন্নেছা ও শতবর্ষী মা মনোয়ারার সাথে কথা কাটাকাটি হয়।
মুন্নার দাবি, কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে মাসুদ বলেন, ‘বুড়িকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই’। সাথে সাথেই ঘরে থাকা কাঠের পিড়ি দিয়ে ফুফু মেহেরুন্নেছার মাথায় আঘাত করেন মুশফিক। দুই তিন মিনিট পর মুসলিম কাপড় দিয়ে বৃদ্ধা মেহেন্নেছার গলায় পেচিয়ে ধরলে তিনি মারা যায়। চোখেল সামনে মেয়ের মৃত্যু দৃশ্য দেখে ৯৭ বছর বয়সী মা মনোয়ারা চিৎকার করলে মাসুদের নির্দেশে তাকে গলা টিপে হত্যা করে মুসলিম।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মাহফুজ বলেন, মুন্নার নেতৃত্বে পুরো ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর আলমিরায় থাকা ব্যাগভর্তি ২০ লাখ টাকা লুট করে সবাই মিলে ভাগাভাটোয়ারা করে নেয়। মা মেয়ের লাশ দুটি ঘরের পানির ট্যাংকিতে ফেলে দেয়া হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) মো. ইলিয়াছ খান জানান, মেহেরুন্নেছা রূপালি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। ভাগিনা মুশফিককে লেখাপড়া, ভাইকে আমেরিকা পাঠানো সবই তিনি করেছেন। আমাবাগানের তিনতলা ভবনটিতে মাকে নিয়ে তিনি থাকতেন। অবসরের পর তার কাছে থাকা নগদ টাকা ও ভবনসহ জমির লোভে বৃদ্ধা মা ও মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় মুন্না ও মাহফুজ ছাড়া আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা হলেন, ভাগিনা মুশফিক, মুসলিম, সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবু ও জমি বিক্রির দালাল মাসুদ রানা। তাদের দাবি আমেরিকা প্রবাসী মাসুদ ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দিয়ে মা ও বোনকে হত্যা করেছে। মাসুদের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট