চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ক্যাবলে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা
ক্যাবলে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা

ক্যাবলে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা

সীতাকুণ্ডে- ৫ শতাধিক দোকানে জাহাজের ক্যাবল বিক্রি

সৌমিত্র চক্রবর্তী সীতাকুণ্ড-

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:১৭ পূর্বাহ্ণ

সীতাকুণ্ড- উপজেলার ফৌজদারহাটের মো. শাহীন একজন ভ্রাম্যমাণ ক্যাবল ব্যবসায়ী। কোন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হলে সেখান থেকে ক্যাবল সংগ্রহ করতে ছুটে যান তিনি। তারপর জাহাজে উঠে যেখানে যেখানে ক্যাবল আছে সেগুলো ভালো করে দেখেন। কোন কোন মানের ক্যাবল আছে দেখে নিয়ে দাম সম্পর্কে একটি ধারণা নেন। পরে সেগুলো কেনার প্রস্তাব দেন জাহাজের মালিক বা তার প্রতিনিধিকে। কখনো সরাসরিই এগুলো কিনে নেবার সুযোগ পান আবারো কখনো আরো অন্য ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে মালিকের ডাকা নিলাম থেকে ক্যাবলগুলো কেনেন তিনি। এদিকে ক্যাবল কিনলেও নিজে কোন খুচরা দোকানে সেসব বিক্রি করেন না। বড় বড় পাইকারী ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে তার। পরে নিজে কিছু লাভ ধরে নিয়ে ক্যাবলগুলো দিয়ে দেন সেসব ব্যবসায়ীদের। আর তার কাছ থেকে ক্যাবল নিয়ে পাইকারী ও খুচরায় ক্যাবল বিক্রি করেন স্থায়ী ব্যবসায়ীরা। এভাবে স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে ক্যাবল সংগ্রহ করে অন্য ব্যবসায়ীদের ক্যাবল

সরবরাহ করেন সীতাকুণ্ডে- এমন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীই রয়েছেন সহস্রাধিক। যারা নিজেরা দিনরাত শিপব্রেকিং ইয়ার্ড ও জাহাজে জাহাজে ঘুরে ক্যাবল কিনে স্থায়ী ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করেন। আবার স্থায়ী দোকানগুলো থেকে এসব ক্যাবল কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করেন অসংখ্য ব্যবসায়ী। সব মিলিয়ে স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা এসব ক্যাবল বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়ে শেষে গ্রাহকের কাছে যায়। এভাবে স্ক্র্যাপ জাহাজের এই ক্যাবলের ব্যবসাতেই প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে সীতাকু-ে। যা দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সীতাকুণ্ড- সাগর উপকূলে বর্তমানে শতাধিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। তবে এর মধ্যে ৬০টির মত ইয়ার্ড সচল রয়েছে। এসব ইয়ার্ডের মালিকরা নিয়মিত স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে তা ভেঙে ব্যবসা করেন। আর এসব জাহাজে রয়েছে অসংখ্য প্রকার সরঞ্জাম। মূল্যবান ধাতব তামা, পিতল, ক্যাবল, ফার্ণিচার, ফ্রিজ, পাখা, কালো তেল, নাটবল্টু, লোহার প্লেট থেকে শুরু করে স্ক্র্যাপ লোহা পর্যন্ত সব সরঞ্জামেরই বিশাল বাজার রয়েছে বাংলাদেশে। তামা-পিতলের মত কিছু কিছু সরঞ্জাম আবার এখান থেকে বিদেশেও চলে যায়। ফলে এসব প্রত্যেকটি সরঞ্জামেরই অনেক দোকান গড়ে উঠেছে এখানে। একইভাবে গড়ে উঠেছে জাহাজ থেকে পাওয়া ক্যাবল বা বৈদ্যুতিক তারের দোকানও।

সরেজমিনে ঘুরে এসব ক্যাবল ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখানে শুধু ক্যাবল ব্যবসায়ীই রয়েছেন ৫ শতাধিক। উপজেলার কুমিরা, বারআউলিয়া, কদমরসুল, মাদামবিবিরহাট, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, সলিমপুর প্রভৃতি এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদামবিবিরহাটে অবস্থিত ক্যাবলের দোকান আল মদিনা স্টিল ও এম.এ এন্টার প্রাইজের ম্যানেজার মো. নাদিম জানান তিনি বিগত ১৮ বছর ধরে এই লাইনে ক্যাবলের ব্যবসা করে আসছেন। এখানে প্রায় ২০ রকমের ক্যাবল তার বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ফ্লেক্সিবল ক্যাবল, পাওয়ার ক্যাবল, স্কিন ক্যাবল, এইচটি ক্যাবল, আরজি ক্যাবল, আর সেট ক্যাবল, এলটি ক্যাবল ইত্যাদি প্রকারের ক্যাবল তার বেশি বিক্রি হয়। ফ্লেক্সিবল ক্যাবল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৫০০-৬০০ টাকা, বিভিন্ন প্রকার পাওয়ার ক্যাবল বিক্রি হয় কেজি ২০০ থেকে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত, আরজি ক্যাবল বিক্রি হয় ৬৫০-৭০০ টাকায়, এলটি ক্যাবল ৩৫০-৪০০ টাকা। এছাড়া কেজি দাম ছাড়াও অনেক প্রকার ক্যাবল তার বিক্রি হয় প্রতি ফিট হিসেবে। এসব মূল্যবান ক্যাবলের ফিট ৫-৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে ক্যাবলগুলো এনে দোকানে সাজানোর পর সেগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান। মাদামবিবিরহাটের অপর ব্যবসায়ী মেসার্স একে কর্পোরেশনের ম্যানেজার মো. সেলিম জানান, জাহাজ থেকে ক্যাবলগুলো আনার পরও সেগুলোকে প্রক্রিয়া করতে হয়। অনেকগুলোর উপরের কাভার খুলে ফেলে ভেতরের তার বের করে বিক্রি করতে হয়। এ কাজেও লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয় অনেক ক্ষেত্রে। প্রচুর ক্যাবল কেনার পর উপরের প্লাস্টিক কভার ছাড়াতে অনেক সময় ঠিকাদারদের স্মরণাপন্ন হন ব্যবসায়ীরা। সে ক্ষেত্রে প্রতি টন তারে খরচ হয় ২২শ থেকে ৩ হাজার টাকা। সেলিম বলেন যারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, ধোলাইখাল প্রভৃতি এলাকা থেকে এখানে এসে ক্যাবল কিনে নিয়ে যান তারা সব রেডিমেড নিয়ে যান। কিন্তু এর আগে আমাদেরকে জাহাজ থেকে কিনে, দীর্ঘ সময় নিয়ে সেগুলো ছাড়ানোসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া করতে হয়। সব মিলিয়ে এসব ব্যবসা। তবে এই দুই দোকানীই জানিয়েছেন, প্রতিদিনই বেশি ক্যাবল বিক্রি হয় না। আবার কোন কোন দিন এক দিনেই টনে টনে ক্যাবল বিক্রি হয়। যার মূল্য হয় কখনো ৫-১০ লাখ বা তারও বেশি। আর খুচরা দৈনিক কয়েক লাখ টাকার ক্যাবল বিক্রি হয় দোকানগুলোতে। সব মিলিয়ে যেসব দোকান আছে তাতে দৈনিক কয়েক কোটি টাকার ক্যাবল বিক্রি হয়। আর বছর শেষে এখানের ক্যাবল ব্যবসা শত শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কোন কোন ব্যবসায়ী বছরে কয়েক কোটি টাকা লাভও করেন। ফলে এ ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রত্যেকে আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়েছেন। এ ব্যবসা নিয়ে তাদের কোনও অভিযোগ নেই। তবে তারা চান যে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এসব ক্যাবল তারা পাচ্ছেন সে শিল্পটি যেন টিকে থাকে। এ শিল্পের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র চলছে দাবি করে তারা বলেন, শিল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে শুধু যে তাদের মত সহস্রাধিক ক্যাবল ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারে দুঃসময় নেমে আসবে তাই নয়, জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপর নির্ভর করা লাখ মানুষের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট