চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

লেখকের দৃষ্টিতে বইমেলা

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ২:১১ পূর্বাহ্ণ

শামসুল আরেফীন, কবি, প্রাবন্ধিক ও লোক গবেষক। চাকরির পাশাপাশি গবেষণা করেই পার করছেন প্রতিদিনকার সময়। নব্বই দশকের শুরুতে ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও বর্তমানে গবেষণায় ডুবে আছেন। এর মাঝেই ১৭টি গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। এবারের বইমেলাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘চট্টগ্রামের লোকগান: বিবিধ প্রবন্ধ’। গ্রন্থটি নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ সাড়া পেয়েছেন। সম্প্রতি পূর্বকোণের পক্ষ হতে লেখকের কাছে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি খুব সুন্দর করে তার উত্তর দিয়েছেন। পাঠকদের জন্য উত্তরগুলো তুলে ধরা হলো।
বই প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেনÑ

‘নব্বই দশকের শুরুতে ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। শূন্য দশকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ও সংকলনে অনেক ছড়া ও কিশোর কবিতা লিখেছি। আমি ’৯০ দশকের প্রায় মাঝামাঝি লোকগবেষণায় যুক্ত হই এবং শুরু করি বিলুপ্ত ও বিস্মৃতপ্রায় লোককবি ও তাদের রচনা উদ্ধার। এ-কারণে আমি শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার আবিষ্কৃত বিলুপ্ত ও বিস্মৃতপ্রায় লোককবি শতাধিক। লোককবিদের মধ্যে আস্কর আলী প-িত, শাহ্ আবদুল জলিল সিকদার, আমানুল্লাহ, আতর আলী, আবুল খায়ের নক্সবন্দি, ঈছা আহমেদ নক্সবন্দি, খাদেম আলী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও আমি লেখালেখির অনেক ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছি; যুক্ত হয়েছি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায়ও। এসব ক্ষেত্রে আমার যা অর্জন বা অভিজ্ঞতা, আমার মনে হয়েছে, সেসব গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা জরুরি। তাই আমি বই প্রকাশ করি।
বই প্রকাশের অনুভূতি নিয়ে লেখক জানানÑ ‘২০০৪ সালে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের বলাকা থেকে প্রকাশিত এই গবেষণা গ্রন্থটির নাম ছিল ‘আহমদ ছফার অন্দরমহল’। প্রথম বই প্রকাশের আনন্দই আলাদা; ভাষায় বুঝিয়ে বলা মুশকিল। এই বইটি রচনা করতে আমার খুবই কষ্ট হয়েছিল। অনেক ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়েছিল। কিন্তু বইটি প্রকাশের শেষদিকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার একটি অপারেশন হয়েছিল। আমি বইটি দেখেছি সুস্থ হওয়ার পর। এই বইটি প্রকাশে আমি অশেষ আনন্দ পেলেও, বেদনাও কম পাইনি। আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ অনেকেই বলেছেন, আমি ব্যবসা করতে ও নাম কুড়োতে বইটি রচনা করেছি। কিন্তু বইটি এখন একটি বিখ্যাত বই।
বই প্রকাশে জটিলতা নিয়ে বলেনÑ ‘আমার ১৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলো বই-ই প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে এই প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ও ইতিহাস-গবেষক জামাল উদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতায়। বইগুলো প্রকাশে আমাকে কোন জটিলতায় পড়তে হয়নি।
বই বিক্রি নিয়ে বলেনÑ ‘অনেকে শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্য লিখেন। শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্য যা ইচ্ছে তা লেখা যায়। কিন্তু একজন প্রকৃত লেখক শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্য লিখেন বলে আমি মনে করি না। সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, বিশ্বের প্রতি মানুষ হিসেবে তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি লিখেন এবং বই প্রকাশ করেন। বই প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর বিক্রি হলে তিনি আনন্দিত বোধ করেন। কিন্তু বিক্রি না হলে হতাশ হন না। কারণ তিনি বোঝেন, প্রকৃত বই কিনেন প্রকৃত পাঠক, এখন সেই পাঠকের অভাব।’
বই প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বলেনÑ ‘আমি অনেক বিষয়ে লিখি। তবে বই করার ক্ষেত্রে আমি লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধকে গুরুত্ব দিই।’
তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেনÑ ‘লিখতে হলে নিরন্তর পড়তে হবে, জানতে হবে, দেখতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
এবারের প্রকাশিত বই স¤পর্কে লেখক জানানÑ ‘এবারের বইমেলায় চট্টগ্রামের বলাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার ‘চট্টগ্রামের লোকগান: বিবিধ প্রবন্ধ’। এই গ্রন্থে ‘চট্টগ্রামের লোকগান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে চট্টগ্রামের লোকগানের বিভিন্ন শাখার বিবরণ প্রদান করা হয়েছে, যেমন, হঁঅলা, মাইজভা-ারি গান, জাহাঁগিরি সঙ্গীত, জারি গান বা মর্সিয়া, কীর্তন, হাইল্যা সাইর, পাইন্যা সাইর, ফুলপাঠ গান, হালদাফাডা গান, গোরব পোয়ার গান, চাডগাঁইয়া গান ও কবিগান প্রভৃতি। চাডগাঁইয়া গানকে লোকগানের অন্তর্ভুক্ত করার কারণে আপত্তি উঠতে পারে। কিন্তু যেহেতু এই গান চট্টগ্রামের লোকসমাজকে বিনোদিত করে এবং এই গানে এই লোকসমাজের চিত্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ফুটে উঠে, সুতরাং এই গানকে চট্টগ্রামের লোকগানের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কোন আপত্তি উঠা উচিত মনে করি না। প্রবন্ধটিতে আমি বলেছি, চট্টগ্রামের লোকগানের সবচেয়ে প্রাচীন শাখা লুকিয়ে আছে চর্যাপদে; এছাড়াও বারমাসী ও গীতিকাকে প্রাচীন শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
গ্রন্থের অন্য ১১টি প্রবন্ধের মধ্যে ১০টি চট্টগ্রামের লোকগান সম্পর্কিত বিষয়-নির্ভর। প্রবন্ধগুলোর নাম: ‘চট্টগ্রামের কবিয়াল ও কবিগান’, ‘লোকগানের অবিনাশী কণ্ঠ কর্ণফুলী কন্যা শেফালী ঘোষ’, ‘অপ্রকাশিত লোককবি রুহুল আমিন’, ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান গ্রন্থে আস্কর আলী প-িতের গান’, ‘আবদুল গফুর হালীর গান’, ‘আস্কর আলী প-িত প্রসঙ্গে’, ‘ঈছা আহমেদ নক্সবন্দির গান’, ‘চট্টগ্রামের বিয়ের গান’, ‘রাহে ভা-ার দরবারের গান’ এবং ‘অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ স্বপন কুমার দাশ’। বাকি ১টি প্রবন্ধ অর্থাৎ ‘বারমাসী গানে বৈশাখ শব্দের ব্যবহার’ প্রবন্ধটি চট্টগ্রামের লোকগান সম্পর্কিত বিষয় ভিত্তিক না হলেও তা উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে চট্টগ্রামের বারমাসীতে বৈশাখ শব্দের ব্যবহার এবং চট্টগ্রামের লোককবি আস্কর আলী প-িত, শাহ্ আবদুল জলিল সিকদার, খাদেম আলী, মোজহেরুল আলম ওরফে ছাহেব মিয়া প্রমুখ কর্তৃক বারমাসী রচনার বিষয়টি পরিস্ফুট হওয়ার কারণে।
উল্লেখ্য, এবারের বইমেলায় বলাকা থেকে আমার ‘আহমদ ছফার অন্দরমহল’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে।’
বইমেলা নিয়ে লেখক জানানÑ গতবার থেকে চট্টগ্রামে একটি মানসম্মত বইমেলা হচ্ছে, এটা বড় ব্যাপার। এটাও বড় ব্যাপার যে, এবার বইমেলাটির পরিসর আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলা একাডেমির বইমেলার পরে এই মেলাটিই এখন আলোচনায়। চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এই মেলার অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট