চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

ভাষা ও শুদ্ধাচারীতা

প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৮:২৯ অপরাহ্ণ

শুদ্ধাচার ভালো কিন্তু অতি শুদ্ধাচারিতা এক ধরনের মৌলবাদিতা। কোনো বিশ্বাস থেকে এক চুল, এক ইঞ্চিও নড়া যাবেনা, এমন বোধ, মৌলবাদের মৌল লক্ষণ। অথচ বিশ্বাসগুলোও সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলার ধারণা সঞ্জাত। মনে রাখলে ভালো যে আমাদের চিন্তা-চেতনাগুলোকে সামাজিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।

মহান একুশকে নিয়ে কিছু চিন্তা যা আমার কাছে অনভিপ্রেত মনে হয়। কেউ বলছেন, রোমান হরফ বা ছডঊজঞণ কি-বোর্ডের ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্যের হানি হচ্ছে। এতে মনে করা হচ্ছে, বাংলা অক্ষরের ব্যবহারের কমতি দেখা দেবে? বিষয়টা খোলা মনে দেখি।
ভাষা হলো নদীর মতো। নদী সতত বহতামান। ¯্রােত কখনো থেমে থাকেনা। খাল, ঝর্ণা, নদী, উপনদী, শাখানদীর ¯্রােতও নদীতে মেশে এবং পরে মিলিত বা মিশ্র ¯্রােত সমুদ্রে মিশে যায়। ভাষা অনন্তকালের বিষয় নয়। এর উৎপত্তিকাল আছে, আছে বিবর্তনের কালপঞ্জি। আজকের বাংলা ভাষা ও অক্ষর সময়ের সাথে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে। বহু তৎসম ও তদ্ভব ও অন্যান্য বিদেশী শব্দের ¯্রােত নিয়ে চলেছে আমার প্রিয়, আমাদের মাতৃভাষা। কালে কালে আরবি, ফারসি ও ইংরেজি শব্দের যোগ হয়েছে এ ভাষায়। যে অক্ষর আমাদের নিজের বলে দাবী করি তার অনেকগুলো অসমীয়রাও ব্যবহার করেন। উল্লেখ্য, খাসিয়ারা এখন রোমান অক্ষরে তাঁদের ভাষা চর্চা করেন। এতে কিন্তু খাসিয়া ভাষা বিলুপ্ত হয়নি বরং এ ভাষায় সাহিত্যচর্চা ও অন্যভাষীদের প্রবেশের সুযোগ বেড়েছে। হিন্দির নিজস্ব অক্ষর বা লিপি নেই, নেই উর্দুর। অথচ দুই ভাষাতেই কৃষণ চন্দর, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, সাদাত হাসান মান্টোর মতো সাহিত্যিক আছেন। রোমান হরফ বা অক্ষর ফরাসি, জার্মান, স্পেনিশ, ইংরেজি, ইন্দোনেশিয়ান, মালয়, ভিয়েতনামি ভাষায় লেখ্যরূপ পেয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষার নিজস্ব অক্ষর আছে। শুধুমাত্র প্রযুক্তির কারণে উচ্চারণ নির্ভর (চযড়হবঃরপ ফবঢ়বহফবহঃ) রোমান অক্ষরে টাইপিং পদ্ধতির ব্যবহার কেন, বাংলা ভাষা বিরুদ্ধ হবে, বোঝা মুশকিল। উল্লেখ্য, শুধু রোমান হরফে বাংলাই নয়, ভারতের অন্য ভাষাগুলোও যেমন হিন্দী, মারাঠী ভাষাও রোমান হরফে লিখবার বন্দোবস্ত আছে। চীনের রোমান হরফে ম্যান্ডারিন লিখবার এ পদ্ধতিকে চরহুরহ বলা হয়। ম্যান্ডারিন একটি জটিল ভাষা হিসেবে পরিচিত। উচ্চারণনির্ভর হওয়াতে বিদেশিদের এ ভাষায় লিখবার জন্য চরহুরহ মোটামুটি সহজ উপায়। খোদ চীনের অনেক নাগরিকরাই এ চরহুরহ পদ্ধতিতে লিখে থাকেন। নিম্নে চরহুরহ কি তার সংক্ষেপ দেয়া আছে।

“ংঢ়বষষরহম ংুংঃবস ড়ভ ঈযরহবংব – চরহুরহ
ঞযব ঢ়যড়হড়ষড়মরপধষ ংুংঃবস ড়ভ ঃযব সড়ফবৎহ ংঃধহফধৎফ ষধহমঁধমব রহ ঈযরহবংব, চঁঃড়হমযঁধ ড়ৎ এঁড়ুঁ, পধহ নব ৎবঢ়ৎবংবহঃবফ নু ষবঃঃবৎং. ঙভ ধষষ ঃযব ষবঃঃবৎং ড়ভ ঊহমষরংয ধষঢ়যধনবঃ, ২৫ ষবঃঃবৎং ধৎব ঁংবফ ভড়ৎ চরহুরহ. খবঃঃবৎ ‘া’ রং হড়ঃ ঁংবফ, যিরষব ষবঃঃবৎ ‘হৃ’ রং ধফফবফ ঃড় ৎবঢ়ৎবংবহঃ ঃযব াড়বিষ ংড়ঁহফ’ুঁ’.” (যঃঃঢ়://বিন.পংঁষন.বফঁ /ূঃীরব/ঢ়পৎ/ংড়ঁহফংুং/রহঃৎড়ঃড়ঢ়রহুরহ.যঃস)
বিবিসি বলছে, “চরহুরহ রং ঃযব সড়ংঃ রিফবষু-ঁংবফ ংুংঃবস ড়ভ ৎিরঃরহম গধহফধৎরহ ঈযরহবংব ঃযধঃ ঁংবং ঃযব খধঃরহ ধষঢ়যধনবঃ.ওঃ রং ধ মৎবধঃ ঃড়ড়ষ ঃড় যবষঢ় ুড়ঁ ষবধৎহ ঃযব ধপপঁৎধঃব ঢ়ৎড়হঁহপরধঃরড়হ ড়ভ গধহফধৎরহ ড়িৎফং.”(িি.িননপ.পড়.ঁশ/ষধ মধঁমবং/ঢ়রহুরহ)
অন্যত্র বর্ণিত আছে, “ঞযবৎব ধৎব ২৬ ষবঃঃবৎং যিরপয ধৎব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ঢ়ধৎঃং রহ ঈযরহবংব চরহুরহ ধং ভড়ষষড়ি : ɑ, ড়, ব, র, ঁ, ǖ, ন, ঢ়, স, ভ, ফ, ঃ, হ, ষ, ɡ, শ, য, ল, য়, ী, ু, প, ং, ৎ, ু, .ি”
উপরের উদ্ধৃতিগুলো দিলাম যাতে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে রোমান হরফে বিভিন্ন ভাষায় উচ্চারণভিত্তিক লিখবার সামর্থ্যরে বিকাশের বিষয়টা বোধে আনার জন্য।
যে সব ভাষা কঠিন ও অক্ষর বহু অথবা অনেকটা চিত্রলিপির মত তাঁদের জন্য উচ্চারণনির্ভর এ পদ্ধতি যথেষ্ট উপযোগী। এতে ভাষার কোন ক্ষতি হবে, তা এখনো মানা কঠিন বরং বহুভাষিতা অর্জন হবে যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
দ্বিতীয় বিষয় যা বহুবার আলোচিত হয়েছে তা হলো, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ৮ই ফাল্গুন বলা হবে না কেন? বিষয়টির সাথে ভাবাবেগ জড়িত থাকলেও তা খুব একটা যথাযথ বিশ্লেষণের সাথে যায় বলে মনে হয়না।
মনে রাখলে ভালো, আমরা প্যান্ট-শার্ট পরি, পিৎজা, বার্গার খাই, বিদেশি আদর্শদ্বারা প্রভাবিত হয়ে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের কথা বলি, তবুও আমরা বাঙালী। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করায়, আমাদের বাঙালিত্বের ক্ষতি হয় না। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পালন করলেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটুও ¤্রয়িমান হয় না। ¤্রয়িমান হয় না আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি গানটি গাইলে। বরং ওই গানের সুর যতটা আমাদের মনে অনুরণন জাগায়, ততটা বোধ হয়, অন্য আদলে হলে হতো না।

আরো মনে রাখা দরকার, আমরা যাকে বাংলা সন বলি, তা অন্য নামে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও ব্যবহৃত হয়। আকবরের উদ্যোগে প্রচলন করা এই সন সুবা এ বাংলার জন্য করা বলে তা বাংলা সন বলে বেশি পরিচিত।এ সন প্রচলনের ক্ষেত্রে ভিন্নমতও প্রচলিত আছে। এই সনের শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাংলার ভৌগোলিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল সংস্কৃতির সাথে জড়িত। জড়িত বাংলার কৃষিব্যবস্থা ও গ্রামজীবনের সাথে। বাংলা সন ও খ্রীষ্টাব্দ যা এখন ঈ. ঊ. বা ঈড়সসড়হ ঊৎধ বলে পরিচিত মূলতঃ দুইই সৌরকেন্দ্রিক ক্যালেন্ডার বা সন। ফলে ফসল ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে করা হিজরী সনের রূপান্তরিত বাংলা সন ও ঈ. ঊ. সনের সময় ও ঋতুর কোন হেরফের হয়না। এজন্যই প্রতি এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। এতে আমাদের উভয় ক্যালেন্ডার বা বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার হিসেবে ঈড়সসড়হ ঊৎধ ব্যবহারের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। চীনের জনগণ ঘটা করে চীনা নববর্ষ পালন করলেও দাপ্তরিক ও দৈনন্দিন কাজে ঈ. ঊ. ব্যবহার করে থাকে। জাপানিরাও তাই করে থাকে।
জাতিসংঘ ঘোষিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দিবস আমরা পালন করি। মহান মে দিবসকে কি বাংলা ক্যালেন্ডারে নামায়ন করলে মে দিবসের আবেদন থাকে? মানবাধিকার দিবস, ভ্যালেন্টাইন’স ডে, পরিবেশ দিবসতো আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হয়ে থাকে, সেখানে এর রূপান্তর কি প্রয়োজন আছে? আমাদের জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী তো ঈড়সসড়হ ঊৎধ অনুযায়ীই হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তো আমরা ঈড়সসড়হ ঊৎধ ব্যবহার করে করছি। আমাদের দেশের সাথে বাইরের দেশগুলোর চুক্তিগুলোতো ঈড়সসড়হ ঊৎধ বা আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী করছি। তো সে সব দিন গুলো বাংলা ক্যালেন্ডারে রূপান্তরের দরকার আছে?

মুসলমানদের ঈদ উৎসব হিজরী ক্যালেন্ডারকে ঘিরে আবর্তিত। সেখানে বাংলা সনের ব্যবহার দরকার আছে?
আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ভালোবাসি অন্য ভাষাকে ঘৃণা বা অবজ্ঞার বিনিময়ে নয়। লেনদেনের এই পৃথিবীতে, ঈড়সসড়হ ঊৎধ সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর নেয়া হয়ে গেছে। আমাদের ও পৃথিবীকে দেয়ার ছিলো।২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করে, পৃথিবীর ছোট-বড় সব ভাষা, সব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার আবেদন করে সভ্যতার জ্ঞান সম্পদকে রক্ষা করবার দিনের ঘোষণা, তা’তে অবশ্যই আমরা গর্বিত। যে সব দেশ এখন চান্দ্রবছর ব্যবহার করে, ২১কে যদি ৮ই ফাল্গুন করা হয় তাহলেও বছরের নির্দিষ্ট সময়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তাঁরা পালন করতে পারবে না। ফলে হিজরী সন ব্যবহারকারীদেরও আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার হিসেবে ঈড়সসড়হ ঊৎধ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। ভাষার স্বাভাবিক ¯্রােতে নদী, শাখানদীর ¯্রােতের সাথে অনেক কিছুই মিলিত হবে, মহাসমুদ্রে মিলনের জন্য। মানবজাতি হচ্ছে সেই মহাসমুদ্র। সারা পৃথিবীর মানুষকে মহাসমুদ্রে মিলনের সুযোগটা আমরাই করে দিলাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট