বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। এ হাসপাতালে এতদিন স্পেশাল আয়া-বয় ও দালালদের অর্থ আদায়সহ নানা অভিযোগ থাকলেও এবার স্বয়ং হাসপাতালের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা আনসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেবা প্রার্থীদের। এ আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্থ আদায় থেকে শুরু করে রোগীকে মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে আনসার সদস্যরা চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনের কাছ থেকে প্রতিদিন বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। শুধু যে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তাও নয়, হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে অসদাচরণ ও দুর্ব্যবহার যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি রোগী ও স্বজনদের গায়ে হাত তোলার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও যেন বিষের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবাদ করলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় এ বাহিনীর সদস্যদের হাতে। তবে হাতের মুঠোয় কিছু টাকা গুঁজে দিলেই সব কিছু মাফ হয়ে যায় । এসব বিষয়ে একাধিকবার হাসপাতালের গণশুনানিতে রোগী ও স্বজনেরা প্রকাশ্যে অভিযোগ করলেও এ বিষয়ে মেলেনি তেমন কোন সুরাহা। এত অভিযোগের পরও থেমে নেই আনসার সদস্যদের অর্থ বাণিজ্য আর হয়রানি। এত কিছুর পরও এ বাহিনীর কমান্ডার জানালেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় শতাধিক আনসার সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। তারা হাসপাতালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড থেকে শুরু করে হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোরেই নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়াও প্রতিটি ওয়ার্ডে অতিরিক্ত দর্শনার্থী ও দালালদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন তারা। পাশাপাশি ডাক্তারদের রাউন্ড চলাকালীন সময় হাসপাতালে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন এ বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে দায়িত্বরত এসব সদস্যরা রোগীদের কাছ থেকে নিয়মিতই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। বলা চলে, তাদের হাতের মুঠোয় কিছু টাকা দিয়ে দিলেই হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রেও ঢুকতে কোন বাধা নেই। আর না দিলে অসদাচরণ ও হাসপাতাল থেকে বের করে দিতেও এক সেকেন্ড সময় নেয় না তারা। সর্বশেষ হাসপাতালের গণশুনানিতে যত অভিযোগ পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠেছে
এ আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে। গণশুনানিতে হেদায়েতুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন অভিযোগ তুলেন, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে টাকা ছাড়া প্রবেশ করতে দেয় না আনসার সদস্য মো. হাছান। এছাড়া ওয়াহিদুল ইসলাম নামে আরেক স্বজন অভিযোগ করেন, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আমার রোগীকে মেডিসিন দিতে গেলে আমাকে টাকা ছাড়া প্রবেশ করতে দেয় নি। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ঘণ্টা খানেক আমাকে বাইরে দাঁড় করে রাখেন, পরে জোর করে প্রবেশ করলে ওয়ার্ডের ভেতরেই আমাকে মারধর করেন। এছাড়া ওহাব নামে এক আনসার সদস্য রোগীর সাথে থাকা স্বজনকে ওয়ার্ডের ভেতর মারধর করেন বলে আরেকজন অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ পাওয়ার পর উপস্থিত আনসার কমান্ডার আবুল কাশেম বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন নজির পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযোগ ওঠা মো. হাছান ও আব্দুল ওহাব নামে ওই আনসার সদস্যরা বর্তমানে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা যায়, হাসপাতালে অতিরিক্ত দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাস কার্ড সিষ্টেম চালু করেছে। ২০ টাকা (ফেরতযোগ্য) জামানত দিয়ে রোগী প্রতি একটি করে দর্শনার্থী পাস দেওয়া হয়। এ পাস কার্ড দিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি প্রবেশ করর সুযোগ থাকলেও একের অধিক স্বজন প্রবেশ করতে চাওয়ায় এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অর্থ আদায় করছেন তারা। হিসেব অনুযায়ী- হাসপাতালের প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিনহাজার রোগী চিকিৎসাধীন থাকে। এসব রোগীদের দেখাশোনা করার জন্য যদি একজন করেও স্বজন হাসপাতালে আসে এবং তাদের কাছ থেকে গড়ে যদি ৫০ টাকা করেও নেওয়া হয় তাহলে প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা আদায় করা হয়। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও চা-পান খাওয়ার নামে প্রতিদিন রোগীদের কাছ থেকে দশ থেকে বিশ টাকা নিয়ে থাকেন। তাছাড়া ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে চাইলে হাতে যদি টাকা না আসে তাহলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। আবার কয়েকটি ওয়ার্ড রয়েছে যেখানে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে অর্থ আদায় করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আনসার কমান্ডার আবুল কাশেম পূর্বকোণকে বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে এখন পর্যন্ত রোগী বা স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করেছে এমন অভিযোগ আমরা পাইনি। তবুও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
গণশুনানিতে যে সকল অভিযোগ পাওয়া গেছে তার কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা এবং এখ পর্যন্ত কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে সকল অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাছাড়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে । তবে সংখ্যা জানা নেই’।