চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

হযরত আবদুল খালেক শাহ (র.)

নাসির উদ্দিন হায়দার

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ

‘না জানি কি গুণ আছে চরণে তোমার/যত দেখি তত সাধ, দেখিতে আবার।/বে ভোলা হই মন হারা-চরণে তাকিয়ে সারা/আঁখিতে পলক ঠার-নাহিগো আমার। (মাওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, রতœভান্ডার)
কালের প্রবাহে চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে আধ্যাত্মিক সাধক ও তাদের ঐশীপ্রেমের এক অনন্য রূপকানন, এই কাননে বাস করেন প্রেমের কারিগর, কবিয়াল রমেশ শীলের ভাষায় যারা ‘প্রেম কাচারি তৈয়ার করি লুকায়ে আছে তার ভিতর।’ আর এই প্রেম-পিয়াসীর চরণে কী গুণ আছে, এক জীবনে তার হদিস পাননি সাধন-সংগীতের দিকপাল, মহিমাময় মানুষ মাওলানা হাদী। উপরিউক্ত গানে তিনি সে কথাই বলেছেন, বে-ভোলা হয়ে মন-হারা হয়ে গুরুর চরণ-সাধনাতেই জীবন সারা হয়েছে তার। আসলেই আধ্যাত্মিক জগত হলো এমনই এক মহাসমুদ্র যেখানে তল পাওয়া বা কূল পাওয়া সহজ কথা নয়।
আধ্যাত্মিক জগতের এক ‘আজব ফুল’ হলেন লোহাগাড়ার দক্ষিণ শুকছড়ি চিশতীয়া দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা সৈয়দ আবদুল খালেক শাহ (র) ওরফে জুলফক্কার সুফী। বাংলা সনের ১ ফাল্গুন (১৪ ফেব্রুয়ারি) মহাসমারোহে হযরত সৈয়দ আবদুল খালেক শাহ (র) এর বার্ষিক ওরশ শরীফ উদযাপিত হয়। এদিন আশেকের মেলা বসে শুকছড়ির প্রেমবাজারে, প্রেমিকজনের ভক্তিবিলাপে মুখরিত হয় দরবার প্রাঙ্গন…
শাহ জুলফক্কার হে দয়ার ভান্ডার/দয়া কর গুরু এসেছি দুয়ারে/নয়ন তুলিয়া চাহনা ফিরিয়া
চোখের জলে কত শুধাই তোমারে।
শুকছড়ি দরবারের হাজার হাজার ভক্ত-আশেকে সেদিনা বে-ভোলা হয়ে গায়…
জাতি-কূল গেল হারাইলাম ঘরবাড়ি/তোমার এনায়েতের প্রেমের ফাঁদে পড়ি/গুনাহগার আনছারী তোমার দুয়ার ছাড়ি/যাব কোথায় আর ডাকিব কাহারে। (গীতিকার : মাওলানা আবুল খায়ের আনছারী)
মাওলানা আবদুল খালেক শাহ ওরফে জুলফক্কার সুফী বাংলা ১২৬৬ সালে (ইংরেজি ১৮৬০ সালে) লোহাগাড়ার দক্ষিণ শুকছড়ি দরবার শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ আমির বুরহান উদ্দিন (র) ইসলাম প্রচারে উদ্দেশে মক্কা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন। মাওলানা আবদুল খালেক শাহ ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত কলকতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি তরিকতের পথে অগ্রসর হন, ভারতের লক্ষেèèৗর বারবাঙ্কি দরবার শরীফের মহান আউলিয়া হযরত আকদছ কুলহুআল্লাহ (র) এর কাছে বায়েত হন। কুলহুআল্কèাহ (র) তাকে ‘জুলফক্কার সুফী’ লকব দিয়ে খলিফা মনোনীত করেন। খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে মাওলানা আবদুল খালেক শাহ ঢোলক কাঁধে নিয়ে নিজ গ্রাম শুকছড়িতে ফিরে আসেন। গ্রামে সামাজিক শত বাধার মুখে তিনি ছিলছিলায়ে চিশতীয়া-নেজামীয়া কর্তৃক অনুমোদিত ছেমা মাহফিল প্রবর্তন করেন। প্রায় শতবছর ধরে সেই ছেমা মাহফিলের মাধ্যমে শুকছড়ি দরবারের ভক্ত-মুরীদানরা চিশতীয়া তরিকার ভাবসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতন সন্ধান করে আসছে।
হযরত আবদুল খালেক শাহ হিজরী ১৩৪৩ সালের ৩ জিলকদ (১৯২৩ সাল) পরলোক গমন করেন। হযরতের অসংখ্য কেরামত লোকমুখে কিংবদন্তী হয়ে আছে। গত ৯৭ বছর ধরে ১ ফাল্গুন জুলফক্কার সুফীর ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মাওলানা আবদুল খালেক শাহ পরদা করার পর তার যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে তরিকতের ঝান্ডা উড়ান তারই সন্তান হযরত সৈয়দ মাওলানা এনায়েত উল্লাহ ছুফী (র)। তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছাত্রাবস্থায় কামেল পীর পিতার হাতে বায়েত হন। পরে লক্ষেèৗর বারবাঙ্কি শরীফের পীর হযরত মেহরাব ছুফীর কাছে পুনরায় বায়েত গ্রহণ করেন। তার কাছ থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে এনায়েত উল্লাহ ছুফী গদীনশীন হন।
হযরত এনায়েত উল্লাহ ছুফী ১৯৮৪ সালের ২৫ অক্টোবর, ১০ কার্তিক, ১ সফর পর্দা করেন। এরপর তার বড় সন্তান হযরত সৈয়দ নেজামুল হক চিশতী (র) ও ছোট সন্তান হযরত সৈয়দ নাছেরুল হক চিশতী সাজ্জাদনশীন হন। হযরত নেজামুল হক শাহ ১৯৯৯ সালের ২১ মে ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে হযরত সৈয়দ নাছেরুল হক চিশতী গদিনশীন আছেন। হযরত এনায়েত উল্লাহ ছুফীর অন্য দুই আধ্যাত্মিক উত্তরসূরী হলেন হযরত সৈয়দ নঈমুল হক চিশতী ও হযরত সৈয়দ নেয়াজুল হক চিশতী। শাহজাদা সৈয়দ এমাদুল হক চিশতীর মতে, হযরত এনায়েত উল্লাহ ছুফী গদীনশীন হওয়ার পর দরবারের শান-শওকত উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের কলকতা, মুর্শিদাবাদসহ নানা জায়গায় হযরত এনায়েত উল্লাহ ছুফীর আধ্যাত্মিক রৌশনী ছড়িয়ে পড়ে, দলে দলে মানুষ তার হাতে বায়েত গ্রহণ করে চিশতীয়া তরিকায় দাখিল হন। তার সময়ে দরবারের ছেমা মাহফিলেরও জৌলুস বাড়তে থাকে। এখনো প্রতি বৃহস্পতিবার ও চন্দ্র মাসের প্রতি ১৪ তারিখ বিপুল মানুষ ছেমা মাহফিলে হাজির হয়ে আধ্যাত্মিক ক্ষুধা নিবারণ করেন। ছেমায় ফার্সি ভাষার শের, হামদ-নাত আর বাংলা বিচ্ছেদ গানের বেশ কদর রয়েছে।
শাহজাদা এহছানুল হক চিশতী ও সৈয়দ মাওলানা আবদুল বাকীর মতে, ‘চিশতীয়া তরিকার সম্মোহনী শক্তির নেপথ্যে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক মানবধর্মের চেতনা। এই চেতনার মূল উপজীব্য হলো ছেমা মাহফিল বা গানবাজনা। এটি এখানকার ‘মস্তানদের’ (প্রমত্তদের) একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ ‘হালকা’ বা বৃত্তাকারনর্তন মৌলানা রূমী প্রবর্তিত ‘মৌলবি’ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য আর ‘ছেমা’ বা সংগীত-সাহায্যে মহিমা কীর্তন চিশতীয়া খান্দানের বৈশিষ্ট্য। চিশতীয়া খান্দানের এই বৈশিষ্ট্য শুকছড়ি দরবারের ছেমা মাহফিলে দৃশ্যমান। চিশতীয়া তরিকার ছেমা মাহফিলের যে সুধা তা পাওয়া যায় শুকছড়ি দরবারে।
শুকছড়ি দরবারের আধ্যাত্মিক দর্শন মানবতাবাদের এক অনুপম অনুষঙ্গ। এই দরবারে সুফী সভ্যতা বা নৈতিক মানবধর্মেরও অনুশীলন দেখা যায়। এই দরবারে সব ধর্মের মানুষ সমান মর্যাদা পান। হযরত আবদুল খালেক শাহ (র) এর দৌহিত্র পীরে কামেল হযরত সৈয়দ নেজামুল হক চিশতীর জীবনাচারে তা পরিস্ফুট ছিল। তার প্রতি সর্বহারা শ্রেণীর মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও ভক্তি ছিল। আর নেজামুল হক শাহও এই শ্রেণীর মানুষের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার মহত্ব দেখাতেন। তিনি জীবদ্দশায় কখনো পরবর্তী দিনের জন্য কোনো সঞ্চয় রাখতেন না, কিন্তু পরদিন সূর্য উঠার আগেই দরবারের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতেন তিনি, তাও তাবিজ-দোয়া থেকে পাওয়া যৎসামান্য হাদিয়া থেকে। এ ছিল তার আধ্যাত্মিক সাধনার মহিমা।
সৈয়দ নেজামুল হক চিশতীর ছোট ভাই সৈয়দ নেয়াজুল হক চিশতী, সৈয়দ নঈমুল হক চিশতী ও সৈয়দ নাছেরুল হক চিশতীর জীবনাচার অধ্যয়ন করে দেখা যায়, তারাও একেকজন তাসাওয়াফ জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।
হযরত সৈয়দ আবদুল খালেক শাহ, হযরত এনায়েত উল্লাহ ছুফী ও সৈয়দ নেজামুল হক চিশতীর আধ্যাত্মিক উত্তরসুরীরা তাদের অনুসৃত ঐশীপ্রেমের ঝান্ডা উড্ডীন রেখেছেন। তাই শতবছরের পথ পরিক্রমায় লোহাগাড়ার দক্ষিণ শুকছড়ি দরবার শরীফ মানবতা ও আধ্যাত্ম সাধনার রূপকানন হয়ে উঠেছে।

নাসির উদ্দিন হায়দার লেখক ও সাংবাদিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট