চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

দ্বৈত শাসনের যাঁতাকলে দ. পাহাড়তলীর জনগণ

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান ৭ জন, বিএনপির ২ জন, আছেন দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীও

২৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আয়তন : ২৪ বর্গ মাইল
জনসংখ্যা : ১ লাখ ১০ হাজার
ভোটার : ৩০ হাজার ৯৪০ জন

কাল প্রকাশিত হবে ২ নং জালালাবাদ ওয়ার্ডের প্রতিবেদন
আল-আমিন সিকদার

দৈ¦ত প্রশাসনের যাতাকলে পিষ্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ড দক্ষিণ পাহাড়তলীর লক্ষাধিক জনগণ। সিটি কর্পোরেশনের এই ওয়ার্ডটি হাটহাজারী সংসদীয় আসনের অধীনে। এই ওয়ার্ডের ৩০ হাজার ভোটার সিটি নির্বাচনের সময় নগরের আর জাতীয় নির্বাচনের সময় ভোট দেন হাটহাজারী সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের। অথচ সীমানা জটিলতায় সংসদীয় আসনের কোন সুযোগ সুবিধা তাদের ভাগ্যে জুটে না।

শুধু তাই নয়, সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করতে না পারলেও সিটি অনুযায়ী খাজনা পরিশোধ করতে হয় তাদের। একই নাগরিক সুবিধা ভোগকারী রাস্তার ওপাশের মানুষেরা হাটহাজারীর হওয়ায় খাজনা পরিশোধ করেন ১ টাকা হারে। যেখানে দক্ষিণ পাহাড়তলীর অর্থাৎ রাস্তার এ পাশের মানুষদের খাজনা পরিশোধ করতে হয় কয়েকগুণ বেশি। সিটি কর্পোরেশনের ১ নং ওয়ার্ড হলেও সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে প্রথম হতে পারেনি ওয়ার্ডটি। বছরের পর বছর অবহেলিত ওয়ার্ডটি। নেই একটি মাতৃসদন হাসপাতাল। বহু জায়গায় পৌঁছায়নি গ্যাস, বসেনি বৈদ্যুতিক খুঁটি। মিলছে না ভবন তৈরিতে সিডিএর অনুমোদন। স্থানীয়দের এমন অভিযোগের শেষ নেই।
স্থানীয়দের এসব অভিযোগের সমাধান দিতে চান আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। আগামী মার্চেই ঘোষণা হতে যাচ্ছে সিটি নির্বাচনের তফসিল। এখন থেকেই ভোটরদের কাছে গিয়ে গিয়ে প্রচারণা চালানো শুরু করেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। দলীয় নমিনেশন পেতে শুরু করে দিয়েছেন দৌড়ঝাঁপ। স্থানীয়দের দিচ্ছেন সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস।

নির্বাচনে মনোনয়নের এ দৌড়ে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে লড়তে চাইছেন ৭ প্রার্থী। পিছিয়ে নেই বিএনপিও। বিএনপির মনোনয়ন পেতে সমানতালে দৌড়াচ্ছেন দুই প্রার্থী। কাউন্সিলর পদে লড়বেন বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও।

কাউন্সিলর পদে লড়তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর জাফর আলম, বর্তমান কাউন্সিলর তৌফিক আহমদ চৌধুরী, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী মো. শফিউল আজিম, ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক হেলাল উদ্দীন আহমেদ, যুবলীগ নেতা আহমদ নূর লোকমান হাকিম ও আখতার হোসেন খোকা। বিএনপির হয়ে লড়তে চাইছেন সিরাজুল ইসলাম রাসেদ ও এম ইলিয়াছ আলী। স্বতন্ত্র হয়ে লড়বেন সাবেক কাউন্সিলর আহমদ হোসেন ও মো. ইকবাল হোসেন রাসেদ। স্বতন্ত্র পদে আরও বেশ কয়েকজন লড়বেন বলে জানা যাচ্ছে। মনোনয়ন দৌড়ে নামা এসব প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে রেখেছেন দ্বৈত প্রশাসনের যাতাকল থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি।

যদিও এর আগের নির্বাচনী ইশতিহারে এই সমস্যার সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান কাউন্সিলর তৌফিক আহমদ চৌধুরী। পাশাপাশি দিয়েছিলেন একটি মাতৃসদন হাসপাতাল করার অঙ্গীকার। কিন্তু তাঁর আমলের শেষ পর্যায় এসে আবারও একই ইশতিহার দিচ্ছেন তিনি। কারণ, এই দুই নির্বাচনী ইশিতাহারের একটিও পূরণ করতে পারেননি তিনি। তবে ৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ক্ষমতায় আসার পর থেকে ওয়ার্ডের জন্য ৫০ কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন কাজ করেছি। এরমধ্যে ৪৮ কোটি ৪৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ৭১টি সড়ক। এছাড়াও এমপি কোটায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকার কাজ করেছি। ইউএনডিপির অর্থায়নের ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা দিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ, শিক্ষা ও ওয়ার্ডের সর্ব সাধারণের জন্য নানান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। এখনও ৫ কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। তবে পূর্বের নির্বাচনী ইশতিহারে যে সমস্যা দুটি সমাধানের কথা দিয়েছিলাম তার মধ্যে একটি হচ্ছে মাতৃসদন হাসপাতাল অন্যটি দ্বৈত প্রশাসন সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান। জায়গার অভাবে মাতৃসদন হাসপাতালটি করা হয়নি। তবে এবার এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো। আর দ্বৈত প্রশাসনের যে ঝামেলা রয়েছে সেটিরও সমাধান হবে। খুব দ্রুতই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থানা হচ্ছে। এটি হলে আশা করি এই দ্বৈত প্রশাসন জটিলতার অবসান হবে। এছাড়া এবার হিন্দু পরিবারের শ্মশান ও মন্দিরের কাজ করব। এই এলাকায় ৩৫ হাজার হিন্দু রয়েছে তাদের জন্য এই কাজ করবো। পাশাপাশি মসজিদের কাজও করা হবে।

এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়াই করবেন মো. জাফর আলম। সাবেক এই কমিশনার এই ওয়ার্ডে ১৭ বছর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন। গত নির্বাচনেও লড়াই করেছিলেন বর্তমান কাউন্সিলর তৌফিক আহমদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এবারের নির্বাচনেও এই আসনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। তিনিও নির্বাচনে জয় লাভ করলে দ্বৈত প্রশাসনিক জটিলতার অবসানের চেষ্টার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে এই ওয়ার্ডকে গড়ে তুলবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘১৯৯৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট ৩ বার জনিপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছি। এই ১৭ বছরে বাবার মত করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। আমার বাবাও একজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন। এবারও এই এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছি। এবার আমি জয় লাভ করলে দ্বৈত প্রশাসনের যে ঝামেলা রয়েছে সেটির সমাধানের চেষ্টা করবো। পাশাপাশি এই ওয়ার্ডে আরও একটি যে বড় সমস্যা রয়েছে সেটি হচ্ছে সিডিএর ভবন নকশা নিয়ে গড়িমসি। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় বহুতল ভবন নির্মানে নকশা দিচ্ছে না সিডিএ। আবাসিক এলাকা করবে বলেও ভূমি অধিগ্রহণ করছে না সিডিএ। দিচ্ছে না নতুন ভবন নির্মাণে নকশা। আধুনিক হচ্ছে না ওয়ার্ড। তবে অনুন্নত হলেও আমাদের খাজনা পরিশোধ করতে হয় ৪০ টাকা। কারণ, এটা সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত। এইসব সমস্যার সমাধান দিতেই নির্বাচনে জনগণকে আমার পাশে চাই।’

এছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন এই ওয়ার্ডের আরও ৫ জন। এই পাঁচজন হচ্ছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী মো. শফিউল আজিম, ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক হেলাল উদ্দীন আহমেদ, যুবলীগ নেতা আহমদ নূর লোকমান হাকিম ও আখতার হোসেন খোকা।
দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী মো. শফিউল আজিম মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন আওয়ামী লীগ থেকে।
তিনি বলেন, ২০১০ এ আমি প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচন করি। তখন ইচ্ছা ছিল মানুষের সেবা করা এবং এলাকার উন্নয়ন করা। এবারও চাইছি নির্বাচিত হয়ে এলাকাবাসীর জীবন মানের উন্নয়ন করতে। এবার দল থেকে মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচিত হলে প্রথমেই সিডিএ’র ভবন নির্মাণের নকশা নিয়ে যে জটিলতা আছে তার সমাধান করবো।
হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, বর্তমান সময়ে নতুন প্রজন্ম মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে জনসচেতনতামূলক কর্মকা- বৃদ্ধি করবো। পাশাপাশি বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো।

লোকমান হাকিম জানান, সুযোগ পেলে সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং বেকার যুবকদের উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে কাজ করবো।
আহমদ নূর জানান, দক্ষিণ পাহাড়তলীর জঙ্গল এলাকার অবহেলিতদের জন্য কাজ করা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টা করবো।
আকতার হোসেন খোকা জানান, বর্জ্য পরিষ্কারে কাজ করা, বয়স্কভাতা প্রদান, জঙ্গি ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়াসহ অবহেলিতদের জন্য কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

অন্যদিকে, কাউন্সিলর পদে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রাসেদ। ফতেয়াবাদ টাউন পার্কের নকশা নিয়ে সিডিএ’র সাথে কাজ করা, শিক্ষা-চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দ্বৈত প্রশাসন সমস্যার সমাধান, স্যানিটেশন সমস্যার সমাধান, টেকনিক্যাল স্কুল ও বয়েজ স্কুল নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজরে কথা জানিয়েছেন পূর্বকোণকে তার নির্বাচনী ইশতিহার হিসেবে। পাশাপাশি নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিস্থিতি কামনা করেছেন তিনি।’
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রাসেদের মত বিএনপি থেকে মনোনয়ন চেয়েছেন এই ওয়ার্ডের বিএনপির সাধারণ সম্পাদকও। সাধারণ সম্পাদক এম ইলিয়াছ আলী পূর্বকোণকে বলেন, ‘দলের সকলেই চাইছে আমি নির্বাচনে অংশ নিই। এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষকে দেখানো যে, বর্তমান সময়ের ভোটের পরিস্থিতি কেমন। পাশাপাশি এটা বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তির আন্দোলনের একটি অংশও। তবুও নির্বাচনে জয় লাভ করলে এই ওয়ার্ডকে একটি আধুনিক ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে তুলবো।’
এদিকে, নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে এই ওয়ার্ডে স¦তন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন বলে আশা ব্যক্ত করেছেন সাবেক কাউন্সিলর আহমদ হোসেন ও মো. ইকবাল হোসেন রাশেদ নামে দু’জন।

সাবেক কাউন্সিলর আহমদ হোসেন নির্বাচনে জয় লাভ করলে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান, প্রশাসনকে সাথে নিয়ে জঙ্গি ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়া, দ্বৈত প্রশাসন সমস্যার সমাধান এবং অত্র এলাকায় সিডিএ’র নকশা প্রণয়ন ও ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন পূর্বকোণকে।
মো. ইকবাল হোসেন রাশেদ জানান, পাহাড় কাটা বন্ধ করা, মাদক নির্মূল করা, অত্র এলাকার সকল সড়কের লাইটের ব্যবস্থা করা। সিডিএর ভূমি অধিগ্রহণের নামে নতুন ভবনের নকশার অনুমোদন নিয়ে নয় ছয় এর প্রতিবাদ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে এলাকাবাসীদের সাথে নিয়ে আন্দোলনের কথা জানিয়েছেন তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট