চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ভুয়া পাসপোর্টে তুরস্ক যাত্রা

পুলিশের হাতে তারা ধরা পড়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নভঙ্গ তিন রোহিঙ্গা যুবকের

নাজিম মুহাম্মদ

২৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:২৭ পূর্বাহ্ণ

পরাধীনতায় মেধাবী তিন রোহিঙ্গা যুবকের সোনালী স্বপ্নের মৃত্যু হলো। দুই সহোদরসহ তিন রোহিঙ্গা যুবক স্কলারশিপ পেয়েছিলেন তুরস্কের সার্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্কাইপিতে তাদের ইন্টারভিউ নেয় সার্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উচ্চশিক্ষার্থে তুরস্কে যাবার সব কার্যক্রম যথারীতি সম্পন্নও করেছিলেন। কিন্তু অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে তুরস্কে যাবার অপরাধে পুলিশের হাতে তারা ধরা পড়েন। অবৈধভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে রোহিঙ্গা যুবকদের বিদেশ নিয়ে যাচ্ছে ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল (ইআরসি)। প্রতিটি পাসপোর্ট তৈরিতে দালালরা নিচ্ছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল (ইআরসি) পাসপোর্ট তৈরির এ ব্যায়ভার বহন করছে। সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। অবৈধভাবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে তুরস্কে যাবার কথা জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিন রোহিঙ্গা যুবক। গ্রেপ্তার তিন যুবক হলেন মিয়ানমারের মংডু জেলার দুমবাই গ্রামের আলী আহমদের দুই ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ (২৩) ও মোহাম্মদ মুসা (২০) এবং জমির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ আজিজ (২১)।

তিন রোহিঙ্গা যুবক ছাড়াও পারভেজ নামের উক্ত দালালকেও গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই।

আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, তারা পাঁচ ভাই, এক বোন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে পরিবারের সাথে তারা শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে আসেন। উখিয়ার থাইংখালি হাকিমপাড়া ক্যাম্পের বি-ব্লকে থাকতেন। ক্যাম্পে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিতে ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করতেন। ওই সময় তুরস্কের একজন ডোনারের সাথে তার কথা হয়। তিনিও রেডক্রিসেন্টে কাজ করতেন। তুরস্কের উক্ত ব্যক্তিকে মিয়ানমারে নির্যাতনের কথা বলেন ইউসুফের বাবা আলী আহমদ। সব শুনে ইউসুফ ও তার ভাই মুসাকে তুরস্কে নিয়ে যাবার আশ্বাস দেন। তিনি একটি মেইলের ঠিকানা দেন।

ইউসুফ জানান, পরবর্তীতে ওই মেইলে যোগাযোগ করে জানতে পারেন ইমেইল ঠিকানাটি ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের (ইআরসি)। ইআরসি জানায়- পাসপোর্ট ছাড়া তারা কোন ধরনের সহযোগিতা করতে পারবে না। তারা বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের স্থানীয় একজন প্রতিনিধির মোবাইল নম্বর দেয়। ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে পারভেজ নামে এক ব্যক্তি তাদেরককে চট্টগ্রামে আসতে বলেন। কথামতো দুই সহোদর ইউসুফ, মুসা ও একই ক্যাম্পের আজিজ ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে এলে রিয়াজউদ্দিন বাজারে পারভেজ তাদের সাথে দেখা করেন। পরবর্তীতে তিন রোহিঙ্গা যুবককে ফেনী নিয়ে গিয়ে আর একজন ব্যক্তির সাথে দেখা করিয়ে দেন। উক্ত ব্যক্তি তিন রোহিঙ্গা যুবককে ফেনী পাসপোর্ট অফিসে নিয়ে আঙ্গুলের ছাপ নেন। ঐদিনই তিনজন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে যান। ১৭/১৮ দিন পর নোয়াখালীর সেনবাগ নজরপুরের ঠিকানা দেখিয়ে তৈরি করা তিন জনের কাছে তিনটি পাসপোর্ট পৌঁছে দেন পারভেজ। প্রতিটি পাসপোর্ট তৈরিতে এক লাখ ২০ হাজার টাকা করে খরচ নিয়েছেন পারভেজ। পাসপোর্টের পুরো ব্যয়ভার বহন করেছে ইআরসি।

ইউসুফ জানান, পাসপোর্ট পাবার পর তারা তিনজনে তুরস্কের সার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে স্কাইপির মাধ্যমে তিন যুবকের ইন্টারভিউ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যথারীতি তিনজনকে নির্বাচিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইন্টারনেটের কানেকশনওয়ালা উখিয়ার একটি কম্পিউটার দোকানে বসেই স্কাইপিতে ইন্টারভিউ দেন তিন রোহিঙ্গা যুবক।

রোহিঙ্গা যুবক ইউসুফ জানান, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনজনকে ঢাকায় যেতে বলে ইআরসি। ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যাবার পথে নগরীর সিটি গেটে আকবরশাহ থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তিন রোহিঙ্গা যুবক।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, তিন রোহিঙ্গা যুবক ধরা পড়ার পর অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরির বিষয়ে তদন্তে নামে পিবিআই। পরে পারভেজ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পারভেজ মুলত দালাল। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশী পাসপোর্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদেশ পাঠানোর কাজ করেন। ভুয়া পাসপোর্ট তৈরির এ চক্রের সাথে সংঘবদ্ধ একটি গ্রুপ জড়িত রয়েছে। পুরো গ্রুপটি সনাক্ত করতে আমরা কাজ করছি। অবৈধভাবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নেয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন রোহিঙ্গা যুবক ইউসুফ ও দালাল পারভেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট