চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘বাণিজ্যিক জোন’ আর কত দূর!

ওয়াল স্ট্রিট চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

গিঞ্জি পরিবেশ, অসহনীয় যানজট, বর্ষায় জলাবদ্ধতা, সরু রাস্তাঘাটসহ নানা সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। ওয়াল স্ট্রিট খ্যাত এই বাণিজ্যপাড়াকে ‘বাণিজ্যিক জোন’ ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিনের। এক দশক পেরিয়ে গেলেও অধরাই রয়ে গেছে সেই দাবি।
দেখা যায়, সকাল থেকে হাজারো শ্রমিক-বণিক, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও ঠেলা-ভ্যানগাড়িতে পণ্য উঠানো-নামানোর ব্যস্ততা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন জেলার ভোগ্যপণ্য কিনতে ছুটে আসেন বণিকেরা। সরু রাস্তায় চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এতে রাস্তায় সারাক্ষণ লেগে থাকে তীব্র যানজট। ব্যবসায়ীরা জানায়, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকায় কমপক্ষে ১০টি সড়ক রয়েছে। সবকটি সড়কই সরু। এসব সড়ক দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করে ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ কয়েক শত যানবাহন। এর ফলে যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার এখান থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করলেও রাস্তা-ঘাট, নালা-নর্দমার উন্নয়নে উদাসীন। ব্রিটিশ আমলের ওয়াল স্টিট খ্যাত এই বাণিজ্যিকপাড়া বর্ষায় কাঁদা-পানি আর জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকে। নিজস্ব ট্রাক টার্মিনাল স্থাপনসহ বিরাজমান সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের প্রস্তাবনায় ছিল, মেরিন ড্রাইভ রোডের সাথে চাক্তাই সড়কে সংযুক্ত এবং কোরবানিগঞ্জ থেকে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারণ করা হলে যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। এছাড়াও কর্ণফুলী নদীর তীরে শাহ আমানত সেতু এলাকায় একটি ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ এবং অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর উন্নয়ন করা হলে যানজট লাঘব হবে।

প্রবীণ ব্যবসায়ী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল হক বলেন, আগের তুলনায় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বেড়েছে শত গুণ। ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কারণেই এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, বন্দর থেকে সরাসরি পণ্যবাহী ট্রাক বাজারের আসছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক ব্যবসায়ী এই অঞ্চল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আদলে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, যশোর-নয়াপাড়ায় বাণিজ্য নগরী গড়ে উঠেছে। বন্দর থেকে সরাসরি নৌপথে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে এসব জেলায়।
চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জজুুড়ে এক আতঙ্কের নাম চেক প্রতারণা। যুগের পর যুগ বিশ্বাসের ওপর ভর করে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আসছিল। আশির দশকের পর থেকে প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। অর্থ আত্মসাৎ, চেক-ডিও জালিয়াতির ঘটনায় বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। তাই মুখে বিশ্বাসে লেন-দেন অনেকাংশে কমে গেছে।

ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে গৌড়ের সুলতান মাহমুদ শাহ চট্টগ্রামে প্রথম পর্তুগীজদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছিলেন। পর্তুগীজ বণিকদের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয় এ জনপদে। পর্তুগীজদের পথ ধরে ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, আরমেনীয় প্রভৃতি পাশ্চত্য দেশের বণিকরা চট্টগ্রামকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধার কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্যে চট্টগ্রামের সুনাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ভোগৌলিক অবস্থার কারণে কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই খালকে ঘিরে গড়ে উঠে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে বাণিজ্য কেন্দ্র। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ছাপিয়ে তা আশপাশের বিশাল এলাকায় বিস্তৃতি লাভ করে। সারা দেশের ব্যবসায়ীরা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকাকে যুক্তরাজ্যের ওয়াল স্টিট এর ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থভূমিতে পরিণত করেছে।

ইতিহাসবিদ-কবি ওহিদুল আলম রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, মুসলিমদের বিজয়ের আগে কর্ণফুলী নদী বদরপাতির ঘাটফরহারবেগের সংলগ্ন ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের এলাকা। আর দক্ষিণাঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। চকবাজার ছিল দর্শনীয় স্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের আড্ডাস্থল। এখান থেকে বিভিন্ন স্থানে কাপড় সরবরাহ করা হত। কর্ণফুলী ক্রমশ: ভরাট হয়ে দক্ষিণ দিকে সরে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যও দক্ষিণে বিস্তার লাভ করে। সদরঘাটে লবণ গোলা জেটি ও কাস্টমস অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিংবদন্তি রয়েছে, হামিদুল্লাহ খাঁ স্থাপিত বাজারসংলগ্ন এলাকাটিতে তাঁর দ্বিতীয় পতœী খাতুন বিবির নিজস্ব জমিতে ক্রমান্বয়ে দোকানপাট স্থাপিত হয়। তখন সে এলাকাটি খাতুন বিবির নামের স্মারকরূপে খাতুনগঞ্জ নামে খ্যাত হয়। পরবর্তীতে আশপাশ এলাকাজুড়ে বিশাল গঞ্জ গড়ে ওঠে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. মহিউদ্দিন বলেন, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে এ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল অবাঙালিদের দখলে। পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ আমদানি-রপ্তানিকারক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পাকিস্তানের করাচি, বোম্বের লোকজনই একচেটিয়াভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। বার্মা (মিয়ানমার) থেকে আমদানি হতো ধান-চালসহ কয়েকটি পণ্য। এ সময় পূর্ব বাংলার শতকরা ১০ জন লোক ব্যবসায় জড়িত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাঙালিদের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য ফিরে আসে।
কর্ণফুলী নদীর শাখা খাল চাক্তাই খাল ছিল এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের আশীর্বাদ। দখল-দূষণ আর ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সেই খাল দুটি এখন অভিশাপের তিলক এঁকে দিয়েছে। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতায় লাখ লাখ টাকার পণ্য নষ্ট হয়। অথচ এ খাল দিয়ে এক সময়ে বার্মা, আকিয়াবসহ দেশ-বিদেশের বড় বড় জাহাজ চলাচল ও নোঙর করত।

চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি আলহাজ এস এম হারুনুর রশিদ বলেন, চাক্তাই খাল দিয়ে পাকিস্তান আমলেও বড় বড় নৌকা চলাচল করত। পাথরঘাটা ও খাতুনগঞ্জের লামার গঞ্জ এলাকায় নৌকা-সাম্পান ভিড়ত। স্বাধীনতার পর ব্যবসা-বাণিজ্য ঢাকা কেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। বিভিন্ন কোম্পানির সদর দপ্তরগুলো ধীরে ধীরে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। বাণিজ্যিক রাজধানী গড়ে তোলার জন্য যে অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা, তা নিয়েও বিমাতাসূলভ আচরণ করেছে সরকারগুলো। নানা সমস্যায় জর্জরিত চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এখন ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হয়েছে। তারপরও চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট