চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ওমরাহ এর নিয়মাবলী

অনলাইন ডেস্ক

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৮:০৫ অপরাহ্ণ

ওমরাহ শব্দের অর্থ হল পরিদর্শন করা বা সাক্ষাৎ করা। ইসলামের ভাষায় পবিত্র হজ্জের সময় ব্যতিত অন্য যেকোন সময়ে পবিত্র কাবা ঘর পরিদর্শন (তাওয়াফ) করাকে ওমরাহ বলা হয়ে থাকে। মহান আল্লাহর অশেষ রহমত যে তিনি আমাদের বছরের যেকোনো সময় উমরাহ পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। পবিত্র হজ্জ শুধুমাত্র জিলহজ মাসে পালন করা যায়। কিন্তু ওমরাহ যেকোনো সময়ে পালন করা সম্ভব। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে ওমরাহ আদায়ের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। অনেকে আবার হজ্জ পালনের আগে উমরাহ পালন করে থাকেন। এরপর একই ইহরামে হজ্জ পালন করেন।

প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা পবিত্র মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাদের উদেশ্য ওমরাহ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, এক ওমরাহ হতে অন্য উমরাহ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সবকিছুর গুনাহের কাফফারা। আর মাবরুর হজের প্রতিদান হলো জান্নাত ( বুখারী ও মুসলিম)। অন্য হাদীস শরীফে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা বারবার হজ্জ ও ওমরাহ আদায় কর, কেননা এ দুটো দারিদ্রতা ও গুনাহকে সেভাবে মুছে ফেলে, যে ভাবে কর্মকারের হাওয়া দেয়ার যন্ত্র লোহার ময়লাকে দূর করে থাকে। (নাসায়ী শরিফ।)

তবে ওমরাহ পালনের বেশ কিছু নিয়মাবলী আছে। এই সব নিয়মগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। তাছাড়া ওমরাহ কবুল না হবার সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমাদের মধ্যে অনেকেই এই সমস্ত নিয়মগুলো ঠিক মত জানেন না অথবা উদাসীন থাকেন। তাই আমাদের আজকের লেখার উদ্দেশ্য হল উমরাহ পালনের অবশ্যক নিয়মাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা।

উমরাহের ফরয এবং ওয়াজিব

ওমরাহ পালনে অবশ্যক শর্তের মধ্যে এর ফরয ও ওয়াজিব গুলো পড়ে। এগুলো হলঃ

দুটি ফরজ: (ক) ইহরাম পরিধান করা (খ) পবিত্র কাবা গৃহ তাওয়াফ করা

দুটি ওয়াজিব: (ক) সাফা ও মারওয়া মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে ৭ (সাত) বার সায়ী করা (খ) মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।

 

এখন আমরা সংক্ষেপে এই ফরয এবং ওয়াজিব কাজগুলো ব্যাখ্যা করব।

(ক) ইহরাম পরিধান

ইহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হল হারাম বা নিষিদ্ধ। ইসলামের ভাষায় ইহরাম অর্থ নির্দিষ্ট কিছু পোশাক পরিধান করার মাধ্যমে নিয়ত ও তালবিয়া সহকারে আপাতদৃষ্টিতে কিছু হালাল কাজকেও নিষিদ্ধ বলে মেনে নিয়ে হজ্জ বা উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করা। পুরুষরা ইহরামের জন্য প্রস্তুতকৃত সাদা দুটি চাদর ও মহিলারা তাদের সাধারণ পোষাক পড়ার মাধ্যমে ইহরাম বাধবেন।

ইহরাম পরিধান হজ্জ এবং ওমরাহের প্রথম শর্ত। ইহরাম বাধার পূর্বে বেশ কিছু অবশ্যকরণীয় কাজ আছে। এগুলো হলঃ

১। ইহরাম বাধার আগে সব ধরনের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। যেমন হাত পায়ের নখ কাটা, গোফ, চুল ও নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদি।

২। ইহরাম বাধার আগে গোসল করা সুন্নত।

৩। এরপর পুরুষদের সেলাইবিহীন পোশাক ও মহিলাদের যেকোন উপযুক্ত পোশাক পরিধানের মাধ্যমে ইহরাম বাধতে হবে।

৩। গোসলের পর ওযু করে ২ রাকাত নফল নামায পড়তে হবে।

৪। মিকাত বা তার পূর্বে উমরাহের নিয়ত করতে হবে।

৫। এর পর তালবিয়া পড়তে হবেঃ

লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক, লাব্বাঈক, লা-শারীকা-লাকা লাব্বাঈক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক।”

অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোন অংশীদার নেই।

পুরুষদের উচ্চ স্বরে এবং নারীদের অনুচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়তে হবে।

ইহরাম বাঁধার পর নিষিদ্ধ কাজ সমুহ

ইহরাম বাধার পর কিছু কাজ আছে যেগুলো নিষিদ্ধ। আপাত দৃষ্টিতে অনেক হালাল কাজও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এগুলো হলঃ

১) সেলাইযুক্ত যে কোন কাপড় বা জুতা ব্যবহার, এক্ষেত্রে স্পঞ্জ সেন্ডেলের ব্যবহার করতে হবে।

(২) মস্তক ও মুখমণ্ডল (ইহরামের কাপড়সহ যেকোনো কাপড় দ্বারা) ঢাকা।

(৩) পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।

(৪) চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা।

(৫) নখকাটা।

(৬) ঘ্রাণযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো।

(৭) স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা।

(৮) যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ বা কোন কথা বলা।

(৯) শিকার করা।

(১০) ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা।

(১১) চুল দাড়িতে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা, যাতে ছিড়ার আশংকা থাকে।

(১২) শরীরে সাবান লাগানো।

(১৩) উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোন জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা।

(১৪) যে কোন ধরনের গুনাহের কাজ করা।

(খ) পবিত্র ক্কাবা ঘর তাওয়াফ

তাওয়াফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল পরিদর্শন বা প্রদক্ষিণ। ইসলামের ভাষায় নির্দিষ্ট নিয়মাবলী মেনে, নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পবিত্র কাবা ঘরের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ করা বলা হয়ে থাকে।

পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ।

তাওয়াফ করার পূর্বে কিছু নিয়মাবলী আছে যেগুলো মেনে চলতে হয়। এগুলো হলঃ

১. তাওয়াফের নিয়ত করা।

২. পবিত্র ক্বাবা (৭) সাতবার বিরতিহীনভাবে প্রদক্ষিণ করা।

৩. পবিত্র হওয়া (ওজু/গোসল করা)।

৪.  সতর ঢাকা।

৫. সক্ষম ব্যক্তির পদদলে তাওয়াফ করা।

৬. ক্বাবাকে বামে রেখে তাওয়াফ করা।

৭. হাতিমের বাহির দিয়ে তাওয়াফ করা।

৮. তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত সালাত আদায় করা।

৯. হজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফের প্রত্যেক চক্কর আরম্ভ করা।

১০. হজরে আসওয়াদে চুমু প্রদান, স্পর্শ করা কিংবা হাত দিয়ে ইশারা করা।

১১. উমরা পালনকারীর তাওয়াফে ইজতিবা ও রমল করা।

১২. প্রতি চক্করে রুকুনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা, সম্ভব না হলে, ইঙ্গিত করা এবং দোয়া পাঠ করা।

তাওয়াফের নিয়মাবলী

হাজরে আসোয়াদকে চুমু খেয়ে, অথবা চুমু খাওয়া সম্ভব না হলে হাতের ইশারা করে ‘বিসমিল্লাহী আল্লাহু আকবার’ বলে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। রুকুনে ইয়ামেনী হতে হজরে আসওয়াদ পর্যন্ত পাঠ করতে হবে- ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া কিনা আজাবান্নার’।

হজরে আসওয়াদ বরাবর হলে পুনরায় আগের নিয়মে ডান হাত তুলে ইশারা করে তাকবীর পড়তে হবে ও ২য় প্রদক্ষিণ আরম্ভ করতে হবে। এভাবে একই নিয়মে পূর্ণ করতে হবে সাত চক্কর। এভাবে তাওয়াফ শেষ করতে হবে।

তাওয়াফ শেষ করে ডান কাধ ঢেকে ফেলতে হবে। এরপর মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে হবে। এরপর জমজমের পানি পান করতে হবে। জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করতে হবে ও পান করার সময় বলতে হবে – ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান নাফি’আ, ওয়ারিযক্বাও ওয়াসি’আ, ওয়াশিফাআম মিন কুল্লি দা’ঈ’ (হে আল্লাহ! আমাকে উপকারী জ্ঞান দান করুন! পর্যাপ্ত রিযিক দান করুন! সকল রোগের শেফা দান করুন)।

উমরাহের ওয়াজিব সমূহ

আগেই বলেছি যে উমরাহের দুটি ওয়াজিব রয়েছে – সায়ী করা এবং মাথা মুণ্ডন করা।

ওয়াযিব – ১ – সায়ী

সায়ী বলতে যা বুঝায় তা হল পবিত্র সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে দ্রুত হাঁটাহাটি করা। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সহধর্মিণী এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর আম্মাজান হযরত হাজরা (রা.) যখন তার শিশুপুত্রের জন্য পানি খুঁজছিলেন, তিনি তখন সাফা ও মারওয়া  পাহাড়ের মাঝে ৭ বার যাওয়া আসা করেন। মহান আল্লাহপাক এই হাঁটাকে এতটাই পছন্দ করে ফেলেন যে তিনি এটাকে হজ্জ ও উমরাহের একটি অংশ হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন।

সায়ী করার নিয়ম

সাফা পাহাড়ের কাছে এসে নিয়ত করতে হবে এবং পবিত্র কুরআন মজিদ হতে পাঠ করতে হবে- “ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শা’আয়িরিল্লাহ…”(নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া মহান আল্লাহ’র নিদর্শনগুলোর অন্যতম…) (সূরা বাক্বারা: ১৫৮)। সাফা পাহাড়ের উপর ক্বাবামুখী হয়ে  মহান আল্লাহর বড়ত্ব, মহিমা ও তাওহীদের বাণী পড়তে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শরীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুম হামদু, ইয়ূহয়ী ওয়া ইয়ূমীত ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর’। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, আনজাযা ওয়া’দাহু, ওয়া নাসারা আবদাহু, ওয়া হাজামাল আহজাবা ওয়াহদাহু’।

এটা দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান। সাফা পাহাড় থেকে নেমে মারওয়ার দিকে কিছুদূর যেতেই দুই সবুজ বাতির মাঝে পুরুষদের দ্রুতগতিতে চলতে থাকতে হবে (মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য নয়) এবং এই দোয়া পড়তে হবে- ‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতাল আ’আজ্জুল আকরাম’। সায়ীর জন্য কোন দোয়া নির্দিষ্ট নেই। মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে, সাফা পাহাড়ে যেভাবে তাসবীহ পড়া হয়েছে ঠিক একইভাবে দোয়া, তাসবীহ পড়তে হবে। এরপর মারওয়া হতে নেমে এসে আবার সাফায় পৌঁছার পূর্বে সবুজ বাতিদ্বয়ের মাঝামাঝি দ্রুতপদে চলতে হবে এবং পড়তে হবে পূর্বের দো’আটি। এভাবে সাত নম্বর হাঁটা বা সায়ী শেষ হবে মারওয়া পাহাড়ে।

ওয়াযিব – ২ – মাথা মুন্ডন (হলক) বা চুল ছাটা (কছর)

ওমরাহের শেষ ধাপ হিসেবে এই ওয়াজিবটি পালন করতে হবে। সায়ী শেষে পুরুষরা তাদের মাথা কামিয়ে ফেলবে বা চুল ছোট করে ছেটে ফেলবে। মহিলাদের চুলের অগ্রভাগ থেকে আধ আঙ্গুল পরিমান কেটে ফেলতে হবে। এই কাজের মাধ্যমে উমরাহের সকল ফরয এবং ওয়াজিব সহকারে উমরাহ সম্পন্ন হবে। এরপর স্বাভাবিক পোশাক পড়া যাবে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে যাওয়া যাবে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়মে উমরাহ পালনের তৌফিক দান করুন, আমিন।

 

 

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট