চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

গুনাহ থেকে বাঁচবেন যেভাবে

মুফতী মুহাম্মদ তাকি উসমানী

২৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:০১ অপরাহ্ণ

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রদত্ত অসংখ্য নেয়ামতের ভেতর ডুবে আছি আমরা। তাই এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করাটাও জরুরি। এই নেয়ামতগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যবহার করা হচ্ছে শুকরিয়া আদায় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সবচেয়ে উত্তম পন্থা। আর এসব নেয়ামত উপভোগ করে আল্লাহর অবাধ্যাচার করা এবং তার দেয়া সবকিছু ব্যবহার করেও গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া হচ্ছে বড় অকৃতজ্ঞতা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বিস্তারিতভাবে সব গুনাহের কাজের বিবরণ দিয়েছেন যা মানুষকে নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও সতর্ক করে বলেছেন, দুটি দুশমন তোমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। ১. নফস ও ২. শয়তান।

আমাদের পরীক্ষা হলো শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচা। নফসের ভেতর ভালো কাজের আগ্রহও জাগবে আবার তৈরি হবে গুনাহের চাহিদাও। মনে গুনাহের প্রতি আসক্তি তৈরি হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর; আবার ভালো হয়ে যাওয়ার পবিত্র অনুভূতি তৈরি হয় না। মনে রাখতে হবে মানুষ ফেরেশতার মতো নয় যে, ‍অন্তরে গুনাহর উদ্রেক হবে না। শুধুই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ফেরেশতাদের। এসব কিছুই তাদের অন্তরে আসে না। মানুষের মনে গুনাহের চাহিদা সৃষ্টি হবে। এই চাহিদা দূর করতে হবে। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে এবং হতে পারবে তার প্রিয়পাত্র।

আমাদের সামনে দুটো পথ। দুটোই খুব সুস্পষ্ট। এক হচ্ছে শয়তানের পথ; যে পথে পাপ, অন্যায়-আনাচার, মনের কুপ্রবৃত্তির ইচ্ছা পুরা করা হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর পথ; পবিত্র ও শুভ্র-স্বচ্ছ এ পথ, এ পথে আল্লাহর হুকুম মানা হয় এবং করা হয় শয়তানকে পরাস্ত, কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে হয়। গুনাহের পথ থেকে যত কষ্টই হোক,  অবলম্বন করতে হবে অনেক দূরত্ব। এটা হচ্ছে মুহাজাদা। এর জন্য ধৈর্যধারণ করতে হবে। মন ঝুঁকে যাচ্ছে গুনাহের দিকে। কিন্তু আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে বিরত থাকছে। ধৈর্য ধরছে। এই ধৈর্যধারণের বিনিময়ে আল্লাহ প্রদান করবেন অনেক উত্তম প্রতিদান।

আল্লাহ মানুষকে চোখ ‍দিয়েছেন তার কুদরত দেখার জন্য। কিন্তু ঘর থেকে বের হলেই গুনাহের শত আয়োজন। চোখ তুলে তাকালেই গুনাহ আর গুনাহ। আজকাল তো ঘরেই; এমনকি পকেটেই গুনাহের সব উপকরণ বিদ্যমান। মোবাইল আছে, তার মাধ্যমে আপনার কুপ্রবৃত্তির চাহিদা পুরা করতে পারেন। চোখের তৃপ্তি আস্বাদন করতে পারেন। কিন্তু সাবধান! আল্লাহ কিন্তু সব দেখছেন! পৃথিবীবাসী দেখুক আর নাই দেখুক। ঈমানের দাবি হচ্ছে অন্তরের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করা। মনের ভেতর যে কুমন্ত্রণা তৈরি হয়, তা আল্লাহই সৃষ্টি করেন। বান্দা যেন তা দমন করে। বান্দা কুপ্রবৃত্তিকে যত দমন করবে ততই সে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারবে। ঈমানি নূর তার অন্তরে সৃষ্টি হবে। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক হবে গভীর।

এমন কোনো অজিফা নেই যা পড়লে গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। বরং বাঁচতে হবে চেষ্টা করে। হ্যাঁ, আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে গুনাহ থেকে বাঁচার। আপনি যেখানে আছেন সেখানে গুনাহে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর স্মরণ অন্তরে উপস্থিত করা এবং কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করা যে, আল্লাহ! আমার চোখ-কান দ্বারা গুনাহের আশঙ্কা হচ্ছে, আপনি হেফাজত করুন; আমার চোখ দ্বারা গুনাহের কাজ হচ্ছে, আপনি হেফাজত করুন; আমার হাত-পা দ্বারা গুনাহের আশঙ্কা হচ্ছে, আপনি হেফাজত করুন। গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং ত্যাগ শিকার করতে হবে। নিজের ওপর বল প্রয়োগ করে হলেও তা থেকে বাঁচার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

যখন ইউসুফকে (আ.) বাদশাহর স্ত্রী পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! এই নারী যে পাপ কাজের দিকে আমাকে আহ্বান করছে তার চেয়ে আমার কছে কারাগারই বেশি পছন্দের।’ চিন্তা করুন, কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! একদিকে পূর্ণ যৌবনদীপ্ত যুবক। দরজা-জানালা সব রুদ্ধ। অন্যদিকে এক নারী স্বপ্রণোদিত হয়ে তাকে অপকর্মের দিকে ডাকছে! ইউসুফ (আ.) আল্লাহর কাছে হেফাজত চাইলেন। অথচ তার অন্তরেও ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিল। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। আসক্তি তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাতে লিপ্ত না হয়ে চিন্তা-চেষ্টা করেছেন বাঁচার জন্য। যদি কোনো ধরনের পাপচিন্তাই না আসে, তাহলে তাতে কী আর বিশেষত্ব থাকল!

যেমন ফেরেশতাদের অন্তরে গুনাহের কোনো ইচ্ছাই জাগে না। মানুষের অন্তরে ইচ্ছা জাগে গুনাহের। মুমিনের কাজ সেই ইচ্ছাকে দমন করা। একজন বুযুর্গ সুন্দর বলেছেন, ধরুন একজন পিপাসার্ত রোজাদার। গরমের মৌসুম। কেউ তার সামনে পানির পাত্র নিয়ে হাজির হলো। তার পানির প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে না? হবে, তবে সে সঙ্গে সঙ্গে ভাববে আমি রোজাদার। ইচ্ছে জাগলেও সে পানি পান করতে চাইবে না। তো এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রথম কাজ হলো আল্লাহর সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করা।

ইউসুফ (আ.) ওই দুঃসময়ে দ্বিতীয় যে কাজটি করেছেন, আল্লাহর নেয়ামতের স্মরণ করেছেন। বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার উত্তম বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে।’ স্মরণ করলেন আল্লাহর নেয়ামতগুলো। আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। সুস্থ রেখেছেন। লালন-পালন করছেন। সুন্দর বসবাসের জায়গা দিয়েছেন। সবকিছু তারই দান। এসব নেয়ামত তারই অবাধ্যতায় কীভাবে ব্যবহার করব? এরপর তিনি ছুটেছেন দরজা অভিমুখে। অথচ দরজা তালাবদ্ধ। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু দরজা পর্যন্ত তো যাওয়া যাবে। অপকর্মের কেন্দ্রস্থল থেকে কিছু দূর তো পালানো যাবে। যদিও দেখছেন তালা ঝুলছে দরজায়। নিজের সাধ্যে ছিল দরজা পর্যন্ত পৌঁছা। তাই সেখানে পৌঁছে গেলেন। তখন বাকি পথ সহজ করে দিলেন মহান আল্লাহ। দরজা খুলে গেল এবং দেখতে পেলেন বাদশা হাজির! কুদরতি উপায়ে বেঁচে গেলেন গুনাহ থেকে। এটা নিছক কোনো ঘটনার ধারাবিবরণী নয়। এতে আমাদের জন্য শিক্ষার অনেক উপকরণ রয়েছে।

ইউসুফ (আ.) আমাদের গুনাহ থেকে বাঁচার পথ ও পদ্ধতি শিখিয়েছেন। তিনটি কাজ করলে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যাবে ইনশাল্লাহ। ১. আল্লাহর কাছে একাগ্র চিত্তে দোয়া করা এবং তার আশ্রয় চাওয়া; ২. তার নেয়ামতের স্মরণ করা এবং ৩. নিজের সাধ্যের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে গুনাহ থেকে বাঁচার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন গুনাহমুক্ত জীবন কাটানোর। আমিন।

 

(লেখক : পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচি জামে মসজিদের মুফতী প্রদত্ত বয়ানের ভিত্তিতে
অনুবাদক : শিহাব সাকিব)

পূর্বকোণ/রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট