চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব

মাহবুবুর রহমান নোমানি

৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ৯:২০ অপরাহ্ণ

অন্তরকে পবিত্র করার নামই আত্মশুদ্ধি। অর্থাৎ ভালো ও উত্তম গুণসমূহ দ্বারা অন্তরকে সজ্জিত করে অন্তর থেকে সব ধরনের মন্দ স্বভাব দূর করা। অন্তরের মন্দ স্বভাব হচ্ছে- কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, অহঙ্কার, রিয়া-লোক দেখানো প্রবণতা, কৃপণতা, কুধারণা ইত্যাদি। ইখলাছ, সবুর, শোকর, আত্মসংযম, আল্লাহভীতি, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল, আল্লাহর ভালোবাসা, বদান্যতা, নম্রতা, ভদ্রতা, সততা ইত্যাদি হচ্ছে অন্তরের উত্তম গুণ। মোটকথা, আত্মশুদ্ধির দিক রয়েছে দুটি। প্রথমত আত্মার ময়লা পরিষ্কার করা। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় মন্দ অভ্যাসগুলো সংশোধন করা। দ্বিতীয়ত পছন্দনীয় গুণাবলী অর্জনের দ্বারা আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা।

আত্মশুদ্ধি কেন প্রয়োজন

দুটি জিনিস দিয়ে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। দেহ এবং আত্মা। এ দুটি জিনিস সুস্থ থাকলেই একজন মানুষকে বলা হবে একজন পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষ। মানুষের যেরূপ দৈহিক রোগব্যাধি রয়েছে, তেমনি আছে রোগব্যাধি আত্মারও। দৈহিক রোগব্যাধির জন্য আমরা চিকিৎসা গ্রহণ করি, শরণাপন্ন হই ডাক্তারের। আত্মিক রোগব্যাধির চিকিৎসা গ্রহণের জন্যও অপরিহার্য আত্মার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। দেহের সুস্থতা নির্ভর আত্মার সুস্থতার উপরেই। অর্থাৎ যদি আত্মা সুস্থ থাকে দেহ দ্বারা সম্পাদিত প্রতিটি কাজকর্ম মানবতার পক্ষে কল্যাণকর প্রতিপন্ন হবে। আর আত্মা অসুস্থ হলে হাত, পা, জবান প্রভৃতি অঙ্গ হিংস্র জীব-জানোয়ারের মতো মানুষ কষ্ট দিয়ে বেড়াবে। তাই দেহের চালক বলা হয় আত্মাকে। আত্মাই পরিচালিত করে মানবদেহকে। নেশাগ্রস্ত মাতাল চালক যেমন একাই ধ্বংস হয় না বরং গাড়ির আরোহীদেরসহ আরও অনেককে ধ্বংস করে, তেমন কল্যাণের জন্য নিবেদিত মানুষ আত্মিক রোগে আক্রান্ত হলে শুধু নিজে নয়; ধ্বংস করবে সমাজও। তাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে সবচেয়ে বেশি তাকিদ প্রদান করেছেন আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে।

আল্লাহ তায়ালা যত কসম করেছেন আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে এত কসম কোনো কথা বলতে করেননি। সূরা আশ-শামসে আল্লাহ সাতটি জিনিসের কসম করে বলেছেন, ‘সেই সফলকাম যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সেই ব্যর্থ মনোরথ যে নিজেকে কলুষিত করেছে।’ অর্থাৎ যার আত্মা পরিশুদ্ধ সেই মানব জীবনের চূড়ান্ত সফলতা লাভ করবে। যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন অগণিত নবী-রাসুল আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরিশুদ্ধ করার জন্যেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর আগমনের চারটি উদ্দেশ্যের কথা। যার দ্বিতীয়টি হলো- তিনি মানুষকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করবেন।

তিনি মাত্র তেইশ বছরের স্বল্প সময়ে মানবাত্মার যথার্থ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে পরিণত করেছিলেন প্রকৃত মানুষে। আইন প্রণয়ন আর আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে নয় বরং তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন আত্মার পরিশুদ্ধিতার প্রতি। তিনি বলেছেন, ‘শোনো, মানবদেহে একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে। সেটা সুস্থ থাকলে সারা দেহ সুস্থ থাকে আর সেটা খারাপ হয়ে গেলে খারাপ হয়ে যায় সারা দেহ। শুনে রাখো, অন্তরাত্মা সেই মাংসপিণ্ড হচ্ছে।’ (ইবনে হিব্বান : ২৯৭)

এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন, পুরো দেহের আমলের ইসলাহ ও সংশোধনকে আত্মার সংশোধনের ওপর নির্ভরশীল। আমরা যাপিত জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু করি প্রথমে সেই কাজের ইচ্ছাটা অন্তরে সৃষ্টি হয়। এরপর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কর্মের মাধ্যমে। সুতরাং, অন্তর পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হলে সেখান থেকে ভালো ও মঙ্গলজনক ইচ্ছাই উৎসারিত হবে। আর অন্তর কলুষিত হলে তার ইচ্ছাগুলোও খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। তাই প্রত্যেকের জন্য অন্তরকে পবিত্র করা অপরিহার্য কর্তব্য।

আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে আত্মশুদ্ধি

মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাযিল হয়েছে মানবজাতির সমাজ সভ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার জন্য। ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনের পথ ও পদ্ধতি ছড়িয়ে আছে এ গ্রন্থের পাতায় পাতায়। শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহকে (সা.) যে কর্মপদ্ধতি দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল তা আল্লাহ পাক নিজেই বর্ণনা করেছেন পবিত্র কোরআনে। তিনি বলেন, ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তার আয়াত পাঠ করবেন তাদের কাছে। তাদের পবিত্র করবেন এবং শিক্ষা দেবেন কিতাব ও হিকমত। এর আগে তারা পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত ছিল।’ (সূরা জুমা : ২) আয়াতে বর্ণিত চারটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহানবী (সা.) আরব সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায়-অনাচার দূরীভূত করে একটি আদর্শ সোনালী সমাজ উপহার দিয়েছিলেন। বর্তমান সমাজচিত্রের দিকে তাকালে চোখে পড়ে আরবে সেই জাহেলিয়াতের দৃশ্য। যা আরবের জাহেলি যুগে ছিল না বর্তমানে সংঘটিত হচ্ছে এমন সব অপরাধ। বাংলাদেশে অহরহ ঘটছে শিশু ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক ঘটনা। ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করার মতো অমানবিকতা কি সেই বর্বর যুগেও কল্পনা করা গেছে? সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সুদ, ঘুষ, দুর্র্নীতি, চাঁদাবাজি। গুম, খুন, ছিনতাই, অপহরণ নিত্যদিনের চিত্র।

জিনা-ব্যভিচার, মিথ্যা, প্রতারণা, স্বার্থপরতা, কপটতা, অসততা, বিশ্বাস ঘাতকতা সমাজের হাল-চাল। ঘুণে ধরা এই সমাজকে সংস্কার করতে হলে অতীব প্রয়োজন নববী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা। অর্থাৎ মহাগ্রন্থ আল কোরআনের শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করা, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুন্নতে রাসুলের অনুসরণ করা এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই সম্ভব একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল, শান্তিময়, কল্যাণকর সমাজ উপহার দেয়া।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ, টঙ্গী।

পূর্বকোণ/রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট