চট্টগ্রাম শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪

যাতায়াতে যত দুর্ভোগ সন্দ্বীপবাসীর

নরোত্তম বনিক

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:০৯ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম জেলার নদী বিচ্ছিন্ন উপজেলা সন্দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় চার লাখ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নদী বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে দিনের বেলায় দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ।

 

চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে ছয়টি ফেরিঘাটের মাধ্যমে দ্বীপবাসীর যাতায়াত। প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার পর পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মালিকানা দ্বন্দ্ব ফিটনেসবিহীন নৌযান ও অবকাঠামোগত ভোগান্তির কারণে এক একটি ফেরিঘাট দ্বীপবাসীর যাতায়াতের যেন এক-একটি যুদ্ধক্ষেত্র।

 

নদী পারাপারে গত ৫ বছরে ৩টি দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৩জন প্রাণ হারিয়েছে। গত ৪২ বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪ জন। এতো প্রাণের বিনিময়েও যাতায়াত ব্যবস্থার তেমন কোন সুফল আসেনি বলে দাবি যাত্রী সাধারণের। অতিরিক্ত ভাড়া, অদক্ষ চালক, লাইফ জ্যাকেট ও ফিটনেসযুক্ত নৌ-যানের অভাবে সন্দ্বীপের নৌ-যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত করুণ।

 

এক সময়ে সন্দ্বীপবাসীর নৌ-যাতায়তের একমাত্র উপায় ছিল বিআইডব্লিউটিএ এর জাহাজ। চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে সন্দ্বীপের পশ্চিমে স্টিমার ঘাটে পৌঁছাতো। সাগরের বুকে নতুন চর জেগে ওঠায় প্রায় ১০ বছর ধরে এই রুট বন্ধ রয়েছে।

 

বর্তমানে উপরিভাগে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবকাঠামো ও নদীতে আরসিসি জেটি ও নৌযানের কারণে ফেরীঘাটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ততম কুমিরা টু গুপ্তছড়া ঘাট। অন্যান্য ঘাটগুলোর চেয়ে এ ফেরিঘাটে তুলনামূলক বেশি নৌযান রয়েছে। তবে মৌসুমে যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে তাদেরও হিমশিম খেতে হয়। এ ঘাটের মালিকানা নিয়ে আবার বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা পরিষদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

 

প্রতিদিন লাখ টাকা রাজস্ব আয় দেওয়া ঘাটে এই বিরোধকে কেন্দ্র করে যাত্রী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার যাত্রী। এ ঘাটে বর্তমানে জেলা পরিষদের ইজারাদারের পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ এর মালিকানাধীন একটি আধুনিক জাহাজ এমভি তাজউদ্দীন আহামেদ চালু রয়েছে। তবে চরের কারণে জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারে না। জেটি থেকে প্রায় দু-তিনশ মিটার দূরে জাহাজ নোঙ্গর করে ফিটনেসবিহীন লাল বোটের মাধ্যমে যাত্রীদের উঠানামা করতে হয়।

 

২০১৭ সালে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে জাহাজ থেকে লালবোটে করে যাত্রী কূলে আসার সময় উল্টে ১৮ জন নিহত হয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে ২০ এপ্রিল স্পিডবোট উল্টে প্রাণ হারিয়েছে আরো চার শিশু। লালবোটে নামতে গিয়ে ১৯ আগস্ট নদীতে পড়ে মারা যান মান্নান মাস্টার (৬০) নামের একজন।

এতো প্রাণের বিনিময়েও তেমন কোন যাত্রী সেবা গড়ে ওঠেনি রুটটিতে। প্রায় ১৮ কিলোমিটার নদী পাড়ি দিতে মাথাপিছু স্পিডবোট ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৩৮০ টাকা। অথচ বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক সারা দেশের নৌরুটগুলোতে স্পিডবোট ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকা।

 

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ঘাটের পরিচালক সামছুল আলম দলু কোম্পানি জানান, এই ঘাটের ইজারার টাকা বেশি। নদীর স্রোতের কারণে অন্যান্য রুটের তুলনায় এই রুটে ভিন্ন ধরনের স্পিডবোট চালানো হচ্ছে। এগুলোতে তেল খরচ দুই থেকে তিনগুণ বেশি লাগে।

 

কুমিরা টু গুপ্তাছড়া রুটে রাতে নদী পারাপারের জন্য অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে চারটি বয়া বাতি স্থাপন করা হয়েছিল। স্থাপনের কয়েকদিন পরে দুটি বয়া বাতি স্রোতে হারিয়ে যায়। বর্তমানে তিনটি বাতি রুটে জ্বলছে। তবে রাতে চলাচলের উপযোগী কোন নৌযান না থাকায় অসুস্থ রোগীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বেশিরভাগ সময় রোগীদের লাল বোট বা কাঠের তৈরি সার্ভিস বোটে করে নদী পাড়ি দিতে হচ্ছে।

 

সন্দ্বীপ আবেদা ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়নাব বেগম জানান, রাতের বেলায় সন্দ্বীপ হল একটা জেলখানার মতো। রোগী মরে গেলেও নদী পাড়ি দিয়ে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম নেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। ডেলিভারি ও হার্টের রোগী এবং দুর্ঘটনায় আহতরা একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্ভোগের কারণে উন্নত চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।

 

অন্য ঘাটগুলোর মধ্যে সীতাকুণ্ডের বাঁকখালী রুটে একটি স্পিডবোট ও দু-তিনটি কাঠের বোট দিয়ে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। তুলনামূলক নদীর দূরত্ব কম হলেও জনপ্রতি চারশো টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। তবে মাঝেমধ্যে এ ভাড়ার পরিমাণ পাঁচশো টাকা পর্যন্ত হয় বলে অভিযোগ যাত্রীদের। তবে এ ঘাট সম্প্রতি ফেরি চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

 

বিআইডব্লিউটিসির অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) এ কে এম আরিফ উদ্দিন জানান, সন্দ্বীপ উপজেলার গাছুয়া টু সীতাকুণ্ডের বাঁকখালী রুটে ফেরি চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ফেরি চলাচলের জন্য উভয় দিকে সড়ক প্রশস্ত করাসহ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। ছোয়াখালি টু কাচ্চাখালী ফেরিঘাট দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। তবে সম্প্রতি এরপাশে আরেকটি রুটে যাত্রী পারাপার চলছে।

 

সন্তোষপুর টু ডোমখালী ঘাট, আমির মোহাম্মদ ঘাট টু ফকিরহাট ঘাটসহ কয়েকটি ঘাটে যাত্রী পারাপার বন্ধ রয়েছে। এগুলোতে শুধু বালুবাহী বলগেট চলাচল করতে দেখা যায়। তবে সন্দ্বীপের সাথে নোয়াখালীর যাত্রী পারাপারের দীর্ঘাপাড় টু উরিরচর ও দীর্ঘাপাড় টু লক্ষীরচর ঘাট চালু রয়েছে। এ দুটি রুটে জোয়ারের সময় যাত্রী, গবাদিপশু ও মালামাল পারাপার করা হয়।

 

সন্দ্বীপের নৌপরিবহনে যাত্রী সেবার বিড়ম্বনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও দুষছে সাধারণ যাত্রীরা। এই বিষয়ে সমাজকর্মী শামসুল আরেফিন শাকিল বলেন, জনপ্রতিনিধিদেরও আন্তরিকতায় ঘাটতি আছে। তারা চাইলে এসব সমস্যা খুব দ্রুত শেষ করতে পারেন।

 

তবে এ বিষয়ে মগধরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কুমিরা টু গুপ্তছড়া ঘাটের ইজারাদার এস এম আনোয়ার হোসেন বলেন, যাত্রী পারাপারের সুবিধার জন্য ব্যক্তিগত অর্থায়নে সবসময় সুযোগ সুবিধা বাড়িয়েছি। নিজস্ব অর্থায়নে এ পর্যন্ত ২০ বারের বেশি কাঠের জেটি তৈরি করেছি। দৈনিক ইজারা বাদ দিয়ে যদি দীর্ঘ মেয়াদি ঘাট ইজারা পাওয়া যায় তবে এ সুযোগ সুবিধা আরো অনেক বাড়ানো যাবে।

 

লেখক : নিজস্ব সংবাদদাতা, সন্দ্বীপ

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট