চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মাদ্রাসা শিক্ষা অতীত ও বর্তমান

মোহাম্মদ শাহ্জাহান সাজু

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:২১ পূর্বাহ্ণ

“পড় তোমার প্রভুর নামে” মানব জাতির উদ্দেশে আল্লাহ পাকের প্রথম আদেশ পড়, এর মাধ্যমে ইসলামে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব কত অপরিসীম তা সহজে অনুমেয়। আর পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মহানবী (স.) এর বাণী “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর উপর ফরয” দ্বারা এই গুরুত্বের প্রতি আরো জোর দেয়া হয়েছে। মূলত ইসলামী শিক্ষার প্রথম সূচনাগার হল মক্কা। মহানবী (স.) জাবালে আবু কুবাইসের পাদদেশে হযরত আরকাম বিন আবিল আরকাম এর বাড়িতে সাহাবাগণকে দ্বীনের শিক্ষা দানের মাধ্যমে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রথা চালু করেন। হিযরতের পর মদিনা মসজিদে এই শিক্ষা দান পদ্ধতি আরো ব্যাপক পরিসরে পরিচালিত হয়। সেই থেকে বিদ্যমান মাদ্রাসা শিক্ষার ধারাবাহিকতা পর্যায়ক্রমে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। আরবি শব্দ “মাদ্রাসা”-এর আভিধানিক অর্থ বিদ্যালয়। আর পরিভাষায় যে নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত করার মানসে সুনির্দিষ্ট পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে শিক্ষা দানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় তাকে মাদ্রাসা বলা যায়। ইসলামী শিক্ষা এবং এর প্রচার প্রসারে মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সূদূরপ্রসারী। রাসূলুল্লাহ (স.) এর জীবনকালে পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যাসহ তাঁর বাণী, সম্পাদিত কাজ ও অন্যের কাজের অনুমোদন ইত্যাদি পরবর্তীতে ইসলামী শিক্ষার পাঠ্যক্রম বা কারিকুলামের বিষয়বস্তু হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (স.) এর ওফাতের পর তাঁর সাহাবাগণ ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে মহানবী (সঃ) এর শিক্ষা কর্মসূচি অপরিবর্তিতভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে মুসলিম সা¤্রাজ্যের বিস্তৃতির সাথে সাথে এই শিক্ষার প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে তা ছিল মসজিদ ও মক্তবভিত্তিক। আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বাগদাদে নিজামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরবের বাইরে ইহা সর্ব প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। আব্বাসীয় যুগে শিক্ষা পদ্ধতির যে ধারা শুরু হয়েছিল তা মুসলিম বিশ্বে আজো বিদ্যমান।

৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম শক্তি, আদর্শ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির আগমন ঘটে। এই সময়ের পর অনেক আমীর-দরবেশ, মুসলিম শাসক ও সূফি সাধকের মাধ্যমে সিন্ধু, পাঞ্জাব, মুলতান, আজমীর, লক্ষেèৗ, ও দিল্লিসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ, খানকাহ্, মক্তব, ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১২০৪ সালে সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বিজয়ের মাধ্যমে এই বাংলায় মুসলিম শাসনের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা ও বিস্তার লাভ করেছিল। মুসলিম শাসকদের প্রশাসনিক কারণে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সহায়তার প্রয়োজন হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দির মাঝামাঝি থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষিতরাই সরকারি প্রশাসনে নির্বাহী পদে আসীন ছিল। ওই সময়ে বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার পরিপূর্ণ ইতিহাস আজও অনুদ্ঘাটিত। শুধু সোনারগাঁয়ে আবু তাওয়ামার মাদ্রাসা ছাড়া বড় কোন মাদ্রাসার হদিস মিলেনি। চতুর্দশ শতাব্দিতে হোসেন শাহী শাসনামলে এই দেশে বহু মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান তার আমলে ঢাকায় একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজ আমলে মুসলমানরা রাজ্যহারা হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি নাগরিক অধিকারও হারাতে হয়। মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশলে বন্ধ করে দেয়া হয়। মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের তীব্র আক্রোশ ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের কারণে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চরমভাবে ভেঙে পড়ে। সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের পদায়ন শূন্যের কোটায় নেমে আসে। এমতাবস্থায় মুসলমানদের ঘোর অনামিশার দুর্দিনে মোল্লা মজদুদ্দীনের নেতৃত্বে ১৭৮০ সালে কলকাতা আলীয়া ম্দারাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের জন্য ইংরেজরা একচেটিয়া মুসলমানদের দায়ী করে আবার তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। ইংরেজদের দমন নিপীড়ন থেকে বাঁচানো ও শিক্ষা দীক্ষায় হারানো গৌরব ফেরানোর লক্ষে স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এগিয়ে আসেন। তৎপরবর্তীতে ১৮৮৬ সালে রামপুর মাদ্রাসা, ১৮৯৮ সালে লক্ষেœৗতে দারুল উলুম ম্দারাসা ও ১৯১৩ সালে সিলেট আলীয়া ম্দারাসা স্থাপিত হয়। ১৮৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। এই সময়ে ইংরেজদের রেখে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হলেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে এ দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা আশানুরূপ উন্নতি সাধন করতে পারেনি। এই সময় কলিকাতা আলিয়া ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকা আলীয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেই সাধারণ শিক্ষায় যে ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল ইসলামী শিক্ষার বেলাই তা হয়নি। কারণ, স্বাধীনতা পরবর্তী সকল শিক্ষা কমিশন ও কমিটিগুলো ইসলামী শিক্ষা তথা মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য যে ধরনের সুপারিশ করেছিল তার সিকিভাগও কার্যকর হয়নি।
আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে দু’ধরনের শিক্ষা ধারা চালু আছে। প্রথমত সাধারণ শিক্ষা, দ্বিতীয়ত মাদ্রাসা শিক্ষা। এ দুটো শিক্ষা ধারা বর্তমানে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। প্রথমোক্ত শিক্ষা ধারার ৯০ ভাগ ভাষা-সাহিত্যসহ নানা প্রকার জাগতিক বস্তুর নাম, গুণ ও ব্যবহারিক নিয়মাবলীর ব্যাখ্যাÑবিশ্লেষণ এবং সমন্বয় সাধনের উপর নির্ভরশীল। আর বাকি ১০ ভাগ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা কেন্দ্রিক। দ্বিতীয়ত মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার ৬০ ভাগ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা আর বাকি ৪০ ভাগ ভাষা সাহিত্য এবং জাগতিক বস্তুর নাম, গুণাগুণ ও তার ব্যবহারিক নিয়মাবলীর সাথে ¯্রষ্টার সম্পর্ক এবং সেসব বিষয়ের উপর ¯্রষ্টার বাণী, নৈতিকতাবোধ প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল। এতে দেখা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, শুধু জাগতিক বস্তুর নাম বা গুণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়, মাদ্রাসা শিক্ষা সর্বপ্রকার বস্তু, বস্তুর নাম গুণ, ¯্রষ্টার সৃষ্ট বস্তুর বহুবিধ ব্যবহার এবং কার্যকরিতা প্রভৃতির আলোচনার সাথে নৈতিক শিক্ষা ও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। মাদ্রাসা শিক্ষা হল নীতি-নৈতিকতা ও দ্বীন-দুনিয়া উভয়ের সমন্বিত একটি সার্বজনীন শিক্ষা। ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার, ধর্মের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক চেতনা এবং এর বিধানাবলী সবকিছুর উৎসমূলে কোরআন ও হাদিসের বাস্তবায়নের ধারা প্রতিফলিত হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে। ফলে কোন মাদ্সা শিক্ষিত এর পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাবস্থায় বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দেখা যায় না। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি, মাদাকাসক্ত, ব্যভিচার, পাপাচার, অন্যায়, বেপরোয়া জীবন-যাপন, সুদ-ঘুষের, ব্যপক চর্চার জন্য সমাজ ও দেশকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করার ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের নাম খুবই কম শোনা যায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ঈর্ষণীয় ফলাফল তাদের প্রতিভা ও মেধার স্বাক্ষর রেখে চলছে।
বর্তমান সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগপোযোগী করে গড়ে তোলার জন্য প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে এখন মাদ্রাসা শিক্ষা একটি উন্নতমানের ও ব্যাপক জনসাধারণের অনুকরণীয় শিক্ষা ধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণ জনগণের হৃদয়-মানসে যতটুকু স্থান পাওয়া উচিত ছিল বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যার কারণে ততটুকু স্থান পায়নি। কারণ, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্য মাদ্রাসা শিক্ষিতদের নিয়োগ না দিয়ে সাধারণ শিক্ষিত এমনকি বিধর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে এ শিক্ষার প্রতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব মাদ্রাসা শিক্ষার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলছে। দেশের চলচিত্র, ইলেক্ট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ধর্মীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে নেতিবাচক সংবাদ প্রচারসহ সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণ জনগণ ইসলামী শিক্ষার প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করছে। তাছাড়াও একশ্রেণির ইসলাম বিদ্বেষী সম্প্রদায় মাদ্রাসা শিক্ষিতদের বিরুদ্ধে তথাকথিত জঙ্গিবাদের অপবাদ দেন। অথচ তারা কি জানেন না? উগ্রধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা সমাজ ও ধর্ম হতে বিচ্যুত বিকৃত-চিন্তার একটি গোষ্ঠী, এরা হয়ত ভুল পথে পরিচালিত হয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে, নতুবা ধর্মকে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এ গোষ্ঠীর সকল সদস্যই মাদ্রাসা শিক্ষিত এমনটি নয় কিন্তু, এখানে অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত, স্কুল কলেজ পড়–য়া তথা আধুনিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়সমূহে সকল বিষয়ে ভর্তির যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ না থাকায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার বিরাজমান বাধা ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর সমাধানে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসলে এক দিকে এ শিক্ষার গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করা হবে। অন্যদিকে শৃঙ্খলিত, দুর্নীতিমুক্ত, সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে এ বিরাট জনগোষ্ঠীকে জাতীয় কল্যাণ নিয়োজিত করা সম্ভব হবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
ছোবহানিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট