চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

খোলা দুধ অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের অপরিহার্য খাদ্য দুধ। দুধ ছাড়া পৃথিবীতে কোন খাদ্যই এককভাবে সব পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ নয়। শিশুদের জন্ম থেকে বিকাশ, প্রাপ্ত বয়স্কদের স্বাস্থ্যরক্ষা এবং রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষার জন্য দুধ অপরিহার্য। একটি সবল ও শক্তিমান জাতি গঠনের জন্য দুধের বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের মেধা গঠনে দুধের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। যে মায়েরা শিশুদের দুধ খাওয়ায়, তাদের স্বাস্থ্যরক্ষার্থেও দুধ অপরিহার্য।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের কোটি কোটি শিশু অপুষ্টির কারণে কৃশকায়ত্ব ও খর্বত্বের শিকার হচ্ছে, যার অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত দুধের অভাব। বিশ্বজুড়ে এখন দুধের মাধ্যমে অপুষ্টির সংকট মোকাবিলার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। অগণিত পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ গরুর দুধে আছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, রিবোফ্লাবিন, ভিটামিন বি-১২ এবং ভিটামিন বি-৫। বিশেষ করে অস্টিওপরেসিস, রিকেট, হাঁড়ের ক্ষয় ও ফাটল এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসার ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে দুধের ভূমিকা পরীক্ষিত। দুধের মধ্যে এন্টি-কারসিনোজেনিক (ক্যান্সার প্রতিরোধী) উপাদানও এখন চিকিৎসা গবেষণায় আলোচিত বিষয়। তবে যাদের করোনারী হার্ট-ডিজিস আছে বা যাদের মোট কোলেস্টেরোল/এলডিএল উচ্চমাত্রায়, তাদের জন্য লো-ফ্যাট দুধই নিরাপদ।
যতই গুণগান হোক, দুধের মান অনেক বড় ফ্যাক্টর। পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পাস্তুরিত দুধ ব্যতীত খোলা বাজারে বিক্রি করা দুধ মোটেই নিরাপদ নয়। রাজধানী ঢাকাতেই দেখেছি, প্রচুর অপাস্তুরিত খোলা দুধ পলিথিনে বা বোতলে ভরে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে সরবরাহ করা হচ্ছে, যা’ আধুনিক নগরজীবনের অনুষঙ্গ। এ নিয়ে ভোক্তাদের কোন সতর্কতা, সচেতনতা নেই। বাজারে ইদানিং হোয়ে পাউডার, ভেজিটেবল ফ্যাট বা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর কৃত্রিম দুধ তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এমনকি সাধারণ মানের মিষ্টি ও দধি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই অপাস্তুরিত দুধের অন্যতম ক্রেতা। এসব দুধ টাইফয়েড, যক্ষা, লিস্টেরিওসিস, ডিপথেরিয়া, ব্রুসেলোসিস, জন্ডিসসহ নানা জটিল রোগব্যধির আকার। খোলা অপাস্তুরিত দুধের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা জাতির জন্য বিপদজনক। এর পশ্চাতে দায়ী আমাদের অজ্ঞানতা, অসচেতনতা। গর্ভবর্তী মায়েদের জন্য অপাস্তুরিত দুধ আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। মহিলাদের আকস্মিক গর্ভপাত এমনকি নবজাতকের মৃত্যুর জন্য লিস্টেরিয়া নামক প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এ ব্যাকটেরিয়া কাঁচা দুধ অর্থাৎ অপাস্তুরিত দুধেই বেশি থাকে। ভোক্তাদের কাছে অপাস্তুরিত দুধের মান তাৎক্ষণিক পরীক্ষার কোন প্রযুক্তি হাতে নেই অথচ তা’ সুদৃশ্য মোড়কে আবৃত করে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে দূষিত পরিবেশে খোলা হাতে গাভির দুধ দোহন করার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত। অটোমিল্কিং এ দেশে এখনও চালু হয়নি। অথচ থাইল্যান্ড শতভাগ অটোমিল্কিং ‘এর আওতায় এসেছে। খোলাভাবে দুধ দোহন প্রক্রিয়ায় বিপজ্জনকভাবে দুধে মাইক্রোঅর্গানিজম তথা প্রচুর পরিমাণ ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে তা’ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-সংগ্রহ কেন্দ্রে পরিবহন করে আনতে দুধের জীবনকাল শেষ হয়। তরল দুধ-দোহনের পর এর জীবনকাল মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা। খোলা দুধে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ এ দুধ দীর্ঘ পথে পরিবহন এবং দীর্ঘ সময় জুড়ে খোলাভাবে সংরক্ষণ করা হয়। ফলে প্রাকৃতিক দুধ তার মৌলিক গুণাগুণ হারায়। অপাস্তুরিত দুধে সালমোনেলা, লিস্টেরিয়া, ইয়েরসিনিয়া, ক্যাম্পিলোবেক্টার, স্টেফি এবং ই.কলি ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। একমাত্র পাস্তুরিতকরণের মাধ্যমে এসব ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পাস্তুরিত বা অপাস্তুরিত উভয় প্রকার দুধই সমান মূল্যে এমনকি গ্রামেগঞ্জে অপাস্তুরিত দুধ আরও বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে, কেজি প্রতি ৭০-৯০ টাকা করে। আমরা এ দুধ কিনে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি সৃষ্টি করছি।
গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মত দূষণমুক্ত দেশেও অপাস্তুরিত দুধ এবং ঐ দুধে তৈরি পনির খেয়ে অনেক নাগরিক অসুস্থ হয়েছিল (সিডিসি রিপোর্ট, ২০০৬)। এ রিপোর্টে অপাস্তুরিত দুধে ১৫০ গুন বেশি রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। কাঁচা তরল দুধ সর্বোচ্চ ৮০ ডিগ্রি এবং সর্বনি¤œ ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পাস্তুরিত করায়ব্যাক্টেরিয়াসহ অন্যান্য জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে দুধের গুণাগুণ অক্ষুণœ থাকে, পুষ্টিমান হ্রাস পায় না। শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, রোগীসহ সবার সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই নিরাপদ পাস্তুরিত দুধ। বাংলাদেশে বর্তমানে বায়ু, মাটি ও পানি দূষণের ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটে গরুর কাঁচা তরল দুধ পাস্তুরিত না করে পান করা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অপাস্তুরিত দুধের পাশাপাশি অপাস্তুরিত দুধে তেরি আইসক্রিম, পনির, মাখন, চকোলেটসহ সব দুগ্ধজাতীয়সামগ্রী স্বাস্থ্যের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ। খোলাভাবে দুগ্ধ দোহন, পরিবহন ও বিপণন কার্যক্রমের পুরোটাই চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।

যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে অপাস্তুরিত তরল দুধের প্রচলন নেই। বিশ্ব ক্যান্সার গবেষণা সংস্থার এক প্রতিবেদনে দুগ্ধজাত সামগ্রীর সঙ্গে ক্যান্সারের একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। সুতরাং অপাস্তুরিত খোলা দুধ অপরিহার্যভাবে শুধু ক্যান্সার নয়, সব রোগের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে এখন পাস্তুরিত কারখানার তৈরি দুধের প্রচলন বাড়ছে। সুতরাং পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের ভাল-মন্দ যাচাই করে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। অবহেলা ও অজ্ঞতায় শরীরে বিষ ঢুকানো আত্মহননের শামিল।
জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশের পরিবর্তন, জীবনাচারের পরিবর্তনের বাস্তবতায় খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন আনতে হবে। শিল্পবর্জ্যরে ব্যাপক দূষণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ঘনবসতির কারণে নতুন নতুন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে খোলা দুধের বিশুদ্ধতার কি নিশ্চয়তা ? চারপাশের পরিবেশ স্বাস্থ্যবান্ধব নয়, কাজেই স্বাস্থ্যসুরক্ষায় বন্ধ করতে হবে খোলা দুধের অভ্যাস। খাদ্যমান রক্ষা আমাদের সবচে বড় চ্যালেঞ্জ। ডেইরি শিল্পের প্রসার ঘটছে, সুতরাং সারাদেশে ছোট-বড় সব ডেইরি ফার্মকে মিল্কভিটা, আড়ং ও প্রাণসহ অন্যান্য পাস্তুরিত দুগ্ধ উৎপাদনকারী কারখানার আওতায় আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে, তবেই পুরোজাতিকে পাস্তুরিত দুধ সরবরাহকরা সম্ভব হবে।

লেখক : মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট