চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিএসটিআই মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ‘মান’ রক্ষা প্রয়োজন

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে কর্মপরিরিধি ও জনবল সরকারি মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়ন করা হয়েছে জাতীয় মান প্রণয়ন ও মান সনদ প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভোক্তা সংগঠন ক্যাব।
বিএসটিআই অধ্যাদেশ (৩৭), ১৯৮৫ এ ক্ষমতাবলে জাতীয়ভাবে খাদ্যদ্রব্যের পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের মান ও সংরক্ষণ পদ্ধতি, পণ্য প্রক্রিয়া-মোড়কজাত, পরীক্ষণ, খাদ্য সংযোজন, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খাদ্য উৎপাদনসহ আট শতাধিক কারিগরি মান নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিএসটিআই আইনে জনস্বাস্থ্য ও জনগুরুত্ব বিবেচনা করে ৫৮টি খাদ্যপণ্যসহ ১৫৪টি পণ্যের মার্কস লাইসেন্স (মান সনদ) বাধ্যতমূলক করা হয়েছে। সনদ ছাড়াও মোড়কে পণ্যের নাম, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা, উৎপাদন-মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ, ব্যাচ নাম্বার, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, ওজন-এসব তথ্য লিখা বাধ্যতামূলক। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য বিএসটিআই ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও উন্নতমানের অত্যাধুনিক ল্যাটরেটরি স্থাপন করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন বাজার মনিটরিং, মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। বিশেষ করে রমজানে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা করা হয়। অথচ ভেজাল-নকল পণ্য বিক্রি ও উৎপাদনের বিরুদ্ধে বড় ভূমিকার রাখার কথা বিএসটিআইয়ের। কিন্তু বিভিন্ন অভিযানে বিএসটিআই’র কার্যক্রম অনেকটা গৌণ হয়ে পড়ে। ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের দাবি, ভেজাল আর নকল পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেলেও বিএসটিআইয়ের যেন মাথাব্যথা নেই। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অফিসকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সরকারি আইন-কানুন মেনে বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। তাই লাইসেন্স না নিয়ে কর্মকর্তাদের খুশি করে পণ্য উৎপাদন, বাজারজাত করার সুবিধা থাকলেও লাইসেন্স নেওয়ার আর দরকার কী। তাই বিএসটিআইয়ের লোগো লাগিয়ে নকল পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া চলে আসছে।’ এসব কারণে সরকার বড় ধরনের রাজস্ব বঞ্চিত হলেও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন অভিযানে উঠে এসেছে, নামী-দামী কোম্পানির পণ্য নকল করে বাজারজাত করা হচ্ছে। আর ভেজাল পণ্য তো আছেই। এসেবর জন্য দায় এড়াতে পারে না মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই। কারণ, বিএসটিআই নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে বড় অভিযান পরিচালনার জন্য সংস্থাটির বড় সুযোগ রয়েছে।
আঠার সঙ্গে রং, সুজি ও পাম অয়েল মিশিয়ে বাঘাবাড়ি ঘি তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায় প্রায়ই। গত রোজায় হাটহাজারী ছাড়াও নগরীর বায়েজিদ শিল্প এলাকা, জামালখানে বাসায় বসে ডালডার সঙ্গে সুগন্ধি ও রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ঘি তৈরি করে ‘পাবনার বাঘাবাড়ির ঘি’ নামে নকল ঘি তৈরির কারখানা পাওয়া গিয়েছিল। নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা ভেজাল ঘি নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত করা হয়। বাঘা বাড়িসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেভেল এবং বিএসটিআইয়ের লগো লাগিয়েও ভেজাল ঘি বাজারজাত করা হচ্ছে। বছর বছর ধরে এসব অবৈধ কারখানা চলে আসছে। বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স ছাড়া নোংরা পরিবেশে তৈরি খাদ্যপণ্যের গায়েও লগো লাগিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এমনকি বিএসটিআইর পদ্ধতি অনুসরণ না করে ভোজ্যতেল উৎপাদন, প্যাকেট ও বাজারজাত করা হয়।
রমজান এবং ঈদ সামনে রেখে ভেজাল পণ্য ছড়িয়ে পড়ে নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। অসাধু একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রতি বছর রমজান ও ঈদ ঘিরে নামী-দামি ব্যা-ের পণ্য নকল ও ভেজাল পণ্য তৈরিতে জড়িয়ে পড়ে। ভেজাল পণ্যের কৌঠায় নকল স্টিকার লাগিয়ে এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করা হয়। যেকোনো পণ্য বাজারজাতকরণের আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিএসটিআইয়ের অনুমতি ও লাইসেন্স নিতে হয়।
বিএসটিআইয়ের চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমদ বলেন, বিএসটিআইয়ের কার্যক্রম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। প্রতিদিনই মোবাইল কোর্ট, সার্ভিলেন্স টিম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিংয়ে বিএসটিআই সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে চট্টগ্রামে জনবল ও বিএসটিআইয়ের ক্ষমতা-কার্যক্রম অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, আগের তুলনায় পরীক্ষা ও লাইসেন্স প্রদানের সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। এখন অনেক পণ্যের পরীক্ষা এখানে করা হয়। এবং অনেক পণ্যের লাইসেন্সও প্রদান করা হয়। সেগুলো আগে ঢাকা থেকে করা হতো।
বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করে পণ্য বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা লোগো নকল করে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের নজরে আসলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মামলা দায়ের করে বিএসটিআই। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধভাবে পানির জারের ব্যবসা বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের অভিযানের পর তা অনেকাংশে কমে এসেছে। তবে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের দাবি, রমজানের আগে ও রমজান শুরুর প্রথম দিকে বিএসটিআইয়ের কার্যক্রমও অনেকটা দায়সারা। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের অভিযানের মধ্যে বিএসটিআই অনেক গৌণ হয়ে পড়ে। মাঠে বড় কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। সরকারি একমাত্র মান নিয়ন্ত্রণকারী এ সংস্থাটি নিজস্ব জনবল দিয়ে সারা বছর অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা রাখে। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ টিম ও পুলিশ প্রশাসন ভেজাল পণ্য ধরতে পারলেও বিএসটিআই কেন পারছে না। এ বিষয়ে সংস্থাটি আরও বেশি সক্রিয় থাকার কথা। ঈদ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ সেমাই ও ঘি বিক্রি হবে। বাজারের ৯৫ শতাংশ ঘিয়ে ভেজাল থাকে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসবের দায় এড়াতে পারবে না বিএসটিআই। ভেজালরোধ, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ‘অকমর্ণ্য’ হয়ে পড়েছে মান নিয়ন্ত্রণকারী এ সংস্থাটি।
বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক সরদার আবুল কালামের এক প্রবন্ধে দেখা যায়, বিএসটিআইয়ের সেবা কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের জন্য ঢাকা প্রধান কার্যালয়সহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এরমাধ্যমে সহজে তৃণমূল পর্যায়ে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বিলিং সফট নামক সফটওয়ারের মাধ্যমে অল্প সময়ে সব ধরনের বিল প্রদান ও গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়াও আমদানি নীতি অনুযায়ী কাস্টমস শুল্কায়নে দেশে কোনো পণ্য প্রবেশের আগে পণ্যভেদে রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন প্রয়োজন হয়। আমদানি সংক্রান্ত কার্যক্রম আরো সহজ ও গতিশীল করার জন্য কাস্টমস কার্যক্রমে সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সফটওয়ারের একমাত্র বিএসটিআইয়ের সফটওয়ার সংযুক্ত করা হয়েছে। এরমাধ্যমে খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করে সফলওয়ারের মাধ্যমে সনদ বা ছাড়পত্র প্রদান করা হচ্ছে। আমদানিকৃত পণ্য বাংলাদেশের সমতুল্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় বিএসটিআই থেকে সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) সেবা কার্যক্রম সহজীকরণে আইএফসি’র সহযোগিতায় সার্টিফিকেট মার্কস কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। এরমধ্যে আবেদন জমা, লাইসেন্স প্রদানে অটোমেটেড/অনলাইন সার্ভিস গ্রহণ, সরকারি ফি জমাদানে ই-পেমেন্টর সুবিধা প্রদান করা হবে। এরফলে ঘরে বসেই সেবা গ্রহণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের সেবা গ্রহণ করতে পারবে। যা খাদ্য নিরাপদে একটি মাইলফলক। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পিউর ফুড আইনকে যুগোপযোগী করে ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রতিটি মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চিয়তা বিধানে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন জারি করেছে।

লেখক ঁ নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট