চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য স্বল্পোন্নতদের সমস্যা

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

সবার জন্য নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়া সহজ কাজ নয়। ভেজাল ও অন্যান্য দূষণের ফলে আমাদের খাদ্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছাড়াও নানা কারণে খাদ্য দূষিত হতে পারে। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ার যে কোন পর্যায়ে খাদ্য খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার রান্নাঘর পর্যন্ত খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষি জমিতে কী পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে, সেই খাদ্যের প্রক্রিয়াজাতের বেলায় উদ্ভূত সঙ্কটগুলো কী উপায়ে মোকাবেলা করা হচ্ছে এবং ওই খাদ্যের মান নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা- এই তিনটি বিষয়ের ওপর মূলত নির্ভর করে খাদ্য নিরাপদ কি না সেটি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি খাবারের মান পরীক্ষার জন্য একটি সমীক্ষা চালায়। প্রাথমিকভাবে ২শ’ হোটেল-রেস্তোরাঁ বেছে নেয়া হয় পরীক্ষার জন্য। মাত্র ৫৭টির খাবার স্বাস্থ্যসম্মত বলে বিবেচিত হয়েছে। এর বাইরের অন্য সব রেস্তোরাঁর খাবার ফুড গ্রেডের অনেক নিচে। সম্প্রতি হাইকোর্ট এক আদেশে বলেছে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি বড় দুর্নীতি। জমিতে উৎপাদিত খাদ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্লেটে পরিবেশন পর্যন্ত যে কোন স্তরে রাসায়নিক দ্রব্য এবং জীবাণুর মাধ্যমে বিষাক্ত বা দূষিত হতে পারে খাদ্য।
সাধারণত নিরাপদ খাদ্যের ঝুঁকি দুই ধরনের : ক. জীবাণু সংক্রান্ত দূষণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ কারণে দূষিত খাদ্য মানবদেহে বিভিন্ন বিরূপ উপসর্গের সৃষ্টি করে। খ. রাসায়নিক দ্রব্যাদি দ্বারা দূষণ। এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত দ্রব্যাদি, পশুর ওষুধের অবশিষ্টাংশ, ভারি ধাতু অথবা অন্যান্য অবশিষ্টাংশ, যা কারও অগোচরে খাদ্যে অনুপ্রবেশ করে।
শিল্পোন্নত দেশে খাদ্যবাহিত রোগের সংখ্যা প্রতিবছর শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনুন্নত দেশসমূহে এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রাপ্তির দুর্বলতা থাকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এসব দেশেই দূষিত খাদ্যজনিত রোগের প্রকোপ ও ব্যাপকতা তুলনামূলক বেশি। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিরই কারণ নয়, দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ। ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারÑএমন দুই শতাধিক রোগের জন্য দায়ী অনিরাপদ খাদ্য। দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন খাদ্যে জীবাণু ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবসে এই প্রশ্নই উঠেছে যে, নিরাপদ খাদ্যের জন্য আমাদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? তবে কিছু উদ্যোগ আশা জাগাচ্ছে। যেমন, ইউএসএআইডির এভিসি প্রকল্পের সহায়তায় দক্ষিণ ডেল্টা অঞ্চলে সবজি ও ফসল চাষে লোকাল জিএপি (গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস) স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণের বিষয়ে ২০০ কৃষককে গত বছর থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে দেশের শীর্ষ সুপারস্টোর চেইন শপ স্বপ্ন।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে সরকার। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর এই আইনের আওতায় ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। বলাবাহুল্য শুধু আইন ও কর্তৃপক্ষই শেষ কথা নয়, প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে নিরাপদ খাদ্য ক্রয় ও গ্রহণের বিষয়ে। শুধু সম্মিলিত সচেতনতার ভেতর দিয়েই খাদ্যের নিরাপদ বলয় তৈরি করা সম্ভব।
নিরাপদ খাদ্য না পেলে জাতি মেধাশূন্য
নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে না পারলে জাতি অসুস্থ ও মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। খাদ্যে ভেজাল ঠেকাতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সাধারণত একটি দেশের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য মজুদ, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিতরণকে খাদ্যনিরাপত্তা বোঝায়। একজন মানুষের বাজারে গিয়ে খাদ্য কেনার সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। আবার বাজারে খাদ্যের উপস্থিতি থাকলেই জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। খাদ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। খাদ্য কেনার সামর্থ্য ও অধিকার থাকতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি জড়িত।
তা হলে খাদ্য নিরাপত্তার পূর্বশর্ত কী? ‘খাদ্য নিরাপত্তার পূর্বশর্ত হলো দেশের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিতরণ করার অবস্থায় থাকা।
একটি দেশের জন্য খাদ্যনিরাপত্তার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো দেশে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য মজুদ না থাকে তাহলে সে দেশে খাদ্য-ঘাটতি এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সর্বত্র খাদ্যের চরম অভাব ও হাহাকার দেখা যায়। সীমিত খাদ্য সরবরাহের জন্য সরবরাহকৃত পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
শুধু খাদ্যনিরাপত্তা থাকলেই হবে না, খাদ্যের বিশুদ্ধতাও গুরুত্বপূর্ণ। ভেজাল খাবার খেয়ে ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে।
বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে খাদ্যনিরাপত্তায় কোনো সমস্যা নেই। এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য কিছু বিষয়ে নজর রাখার দরকার। খাদ্য নিরাপত্তার একটি দিক হলো কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকদের পর্যাপ্ত ও সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। কোন পণ্য-উৎপাদনে কতটুকু সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হবে এবং উৎপাদিত পণ্য- সংরক্ষণের নিয়মনীতি মেনে তা সংরক্ষণ করতে হবে। শুধু কৃষিপণ্য না, অন্যান্য যেসব পণ্য যেমন পশুখাদ্য আছে তা উৎপাদনে ও সংরক্ষণেও সঠিক নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হবে।
নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তিতে খাদ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জও কম নয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশের জন্য খাদ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আইনের সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু লাভের জন্য আমরা নিজেরাই নিজেদের বিষ খাওয়াচ্ছি। এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের মানসিকতা ও আইনের প্রয়োগের অভাব নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তিতে খাদ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
খাদ্য-অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ । ২০১৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি খাদ্য নিরাপদ আইনের প্রবর্তন হলেও কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু এই আইনের সঠিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। আইনের প্রয়োগ হলে বিভিন্ন সময়ে খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তা উঠত না। মানুষ বিনা দ্বিধায় খাদ্যে ভেজাল মেশাতে পারত না।
খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্যে বিগত আইনের পরিবর্তে ২০১৩ সালে নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়ছে। খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, সরবরাহ, মজুদ, পরিবহন, বিতরণ, বিপণনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কেউ খাদ্যে ভেজাল কিংবা আইন বহির্ভূত কোনো কাজ করলে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এসব ব্যক্তি ও কোম্পানির বিরুদ্ধে আইন অনুসারে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

সূত্র ঁ ইন্টারনেট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট