চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

শিশুখাদ্য চটকদার বিজ্ঞাপন প্রলুব্ধ হচ্ছে কোমলমতি শিশু

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

‘টলার, স্টংগার, শার্পার’-বিজ্ঞাপনচিত্রের এই শব্দগুলো এখন শিশুদের মুখে মুখে। এসব চটকদার বিজ্ঞাপনী প্রতারণার ফাঁদে প্রলুব্ধ হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। সুস্বাস্থ্য ও অধিক পুষ্টিগুণের প্রলোভনে শিশুরা খাচ্ছে মুখরোচক ও মানহীন খাদ্য। কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত খাদ্য খেয়ে ভাত, মাছ-মাংস বা শাকসবজি খাওয়া কমিয়ে ফেলছে শিশুরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শিশুকে মানহীন কৌটার দুধ না খাওয়ানোর পরামর্শ দিলেও মিথ্যায় ভরা রকমারী বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে শিশুদের খাওয়াচ্ছেন অভিভাবকদের। শিশু পুষ্টিবিশেষজ্ঞদের অভিমত, এসব প্রচারে মায়ের দুধ খাওয়ানো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে বিকল্প শিশুখাদ্য বিপণন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শিশু বা মাকে আকৃষ্ট করে কোন পণ্যের মোড়ক বা কৌটার গায়ে এমন কোন ছবি দেওয়া যাবে না। যেমন-কার্টুন, ফুল, ছবি ইত্যাদি। এছাড়াও কৌটার গায়ে “মায়ের দুধের বিকল্প, সমতুল্য বা শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই” এমন কথা বাংলায় বড় করে লেখা থাকতে হবে। এছাড়াও বিজ্ঞাপন নীতিমালা অনুযায়ী গুঁড়ো দুধের বিজ্ঞাপনে ৫ (পাঁচ) বছরের কম বয়সের শিশুদের মডেল হিসেবে ব্যবহার না করার নিয়ম রয়েছে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে-২০০৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৪৩ শতাংশ মা শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। মায়েরা চটকদার বিজ্ঞাপনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে গুঁড়ো দুধ বা অন্যান্য কৌটার খাবারের প্রতি ঝুঁকছেন। এ খাবারে শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে গেলে শিশুরা খাবারের রুচি হারিয়ে ফেলে।
দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন বাজার, দোকান, শপিংমল থেকে শুরু করে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান উপরিউক্ত শিশুখাদ্য আইন বা বিধি-বিধান মানা হচ্ছে না। সাজানো কৌটার মোড়কে কার্টন থেকে শুরু করে ফুল, বেলুনসহ নানা ছবি শোভা পায়। শিশুদের আকৃষ্ট করতে এসব ব্যবহার করা হচ্ছে। তা দেখে শিশুরা ঝুঁকছে অখাদ্যের দিকে।
শিশু খাদ্য (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এবং বিধিমালা-২০১৭ এর (৩) ধারার (ঘ) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও উহা ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানিকারক, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারী, বিপণনকারী, বিক্রেতা বা বিতরণকারীর সহযোগিতায় বা অর্থায়নে আয়োজিত কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে কোনো গর্ভবতী নারী, মাতৃদুগ্ধদানকারী, শিশুর মা, শিশুর পরিচর্যাকারী বা অভিভাবককে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, শিশুর বাড়তি খাদ্যের পুষ্টির মান বা উহার ঝুঁকিমুক্ততা সম্পর্কিত অথবা শিশুর শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষতার প্রলোভন সম্বলিত, বিভ্রান্তিকর শিশু স্বাস্থবিষয়ক বার্তা প্রেরণ বা তথ্য প্রচার করা যাবে না।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেল ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে আইনের লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ভোক্তা-সংরক্ষণ আইনেও মিথ্যা, অপ্রাসঙ্গিক চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে কৌটা বা প্যাকেটে এ জাতীয় কোন শব্দ লিখতে পারবে না। কিন্তু প্রস্তুতকারী কোম্পানি বা তাদের এজেন্টরা এসব নীতিমালা মানছে না।
এ বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে বলে মন্তব্য করে এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আইন মেনে শিশুখাদ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা অনৈতিক কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, এই মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। একই সঙ্গে শিশুখাদ্য প্রচারণার বিষয়ে বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার মনিটরিং প্রয়োজন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমদানি করা গুঁড়ো দুধের ৬০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় দু’বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য। জন্মের পরের ছয় মাস শিশুকে বিকল্প শিশুখাদ্যে অভ্যস্ত করে তুলছে ৪০ ভাগ অভিভাবক। এতে আবার গ্রামের চেয়ে শহরের অভিভাবকের সংখ্যা বেশি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ও ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, ‘বাজারের ওপর কারও নজরদারি নেই। কৌটা বা পাত্রের গায়ে খাদ্যে কী কী উপাদান আছে তা পরিষ্কারভাবে লেখার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রতিটি শিশুকে জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।’
শিশু চিকিৎসকের মতে, মায়ের দুধে শিশুর জন্য উপকারী ১১০টি উপাদান আছে। যা শিশুর রোগপ্রতিরোধ, মেধা বিকাশ এবং বেড়ে উঠতে মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে, বাজারে মায়ের দুধের বিকল্প যেসব খাদ্য বিক্রি হচ্ছে তা শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের (ডব্লিউবিবি ট্রাাস্ট) গবেষণা বলছে, ‘ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য আইনÑ২০০৫ পাস হওয়ার আগে তামাকজাত কোম্পানিগুলো সিগারেটের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করত। একইভাবে এখন অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিজ্ঞাপনে নানারকম তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। যেমন-বিভিন্ন ধরনের কৌটার দুধের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, এসব খেলে শিশুরা লম্বা হচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি করছে, দৌড়েÑখেলাধুলায় প্রথম হচ্ছে। যেটা বাস্তবসম্মত নয়। তামাক আইনের মতো এসব মিথ্যা তথ্যে ভরপুর বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধ করা উচিত।
উন্নয়ন সংস্থা ডব্লিউবিবি’র (ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ) গবেষণায় উঠে আসে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিজ্ঞাপনের মধ্যে অধিকাংশই কোমল পানীয়, কৃত্রিম জুস ও প্রক্রিয়াজাত ফলের রস, এনার্জি ড্রিঙ্ক, ফাস্টফুড ও প্যাকেটজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন। টেলিভিশনের প্রচারিত বিজ্ঞাপনের ৪৬ শতাংশ খাদ্যদ্রব্যের। এর মধ্যে আবার ৮ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের, মিষ্টি জাতীয় পানীয়ের বিজ্ঞাপন ১৯ শতাংশ এবং অন্যান্য খাদ্যের বিজ্ঞাপন ১৯ শতাংশ। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাদ্য (যেমন শাকসবজি, ফল-মূল) বিজ্ঞাপন নেই।
গবেষণায় দেখা যায়, ১০০ শিশুর মধ্যে ৯৭ জন শিশু টেলিভিশন দেখে। সেই ৯৭ জনের মধ্যে ৮৮ জন শিশু নিয়মিত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিজ্ঞাপন দেখে। তাদের তিন-চতুর্থাংশ বা ৭১ জন শিশু এসব বিজ্ঞাপন দেখে বাবা-মাকে চাপ দেয় সেসব খাদ্য কিনে দিতে। একাধিক অভিভাবক জানান, বিভ্রান্তি তথ্যে ভরা বিজ্ঞাপন প্রচারে প্রতারণা করা হচ্ছে। মিথ্যা, অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। এসব দেশে শিশুরা ওইসব খাদ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এতে কোমলমতি শিশুরা অখাদ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে।

লেখক ঁ নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট