চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিরাপদ স্বাস্থ্যের জন্য চাই বিশুদ্ধ খাবার

হাসিনা আক্তার লিপি

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

খাদ্য ও স্বাস্থ্য একটি আরেকটির পরিপূরক। বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন বয়সের সব মানুষকেই কিছু না কিছু শারীরিক বা মানসিক কাজকর্ম প্রতিনিয়ত করতে হয়। গাড়ি চালাতে যেমন জ্বালানির প্রয়োজন হয়, তেমনি জীবন-ধারণের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয়। আবার শারীরিকভাবে নিরোগ থাকা এবং দৈহিক বৃদ্ধি ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ খাবার।
বিশুদ্ধ খাবারটা কী?
যে খাবার খেলে শরীর কর্মক্ষম, রোগমুক্ত ও সুস্থ থাকবে, তা-ই হলো বিশুদ্ধ খাবার। সবার জন্য একই ধরনের বা একই পরিমাণের খাবার হবে না। প্রত্যেক মানুষের নিজের দেহের উচ্চতা, ওজন, বি.এম.আই, কাজের ধরন, জীবনযাত্রার প্রণালী ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে এক জন ব্যক্তির সারাদিনের ক্যালোরি নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ যারা ব্যালেন্স ডায়েট বা সুষম খাবারে অভ্যস্ত হবে জীবনের শুরু থেকে, তারাই শারীরিকভাবে ফিট, নিরোগ দেহ, কর্মক্ষম জীবন পেতে পারে।
খাদের ৬টি উপাদান
১। শর্করা : ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, খৈ, পাউরুটি, ওটস, কর্নফ্লেক্স।
২। প্রোটিন : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ সব রকমের ডাল, বীচি জাতীয় খাবার, মটরশুটি, বাদাম, মাশরুম ইত্যাদি।
৩। ¯েœহ/ফ্যাট : তেল, ঘি, মাখন, বাটার, মেয়নেজ।
৪। ভিটামিন : সব ধরনের শাক এবং তাজা কাঁচা ফল।
৫। মিনারেল/লৌহ : মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম, কলিজা, বাদাম, শস্যদানা, সীমের বীচি, সবুজ শাক, শুকনো ফল, খেজুর, কচু, কচু শাক, কচুর লতি, কচুর ছড়া ইত্যাদি।
৬। পানি : পানি দেহের এক আবশ্যিক উপাদান। দেহের ওজনের ৬০-৭০% হচ্ছে পানি। অবশ্যই সেটা বিশুদ্ধ হওয়া চাই-ই। কারণ এই অনিরাপদ পানি পান করার কারণে পানিবাহিত অনেক রোগে শিশু থেকে শুরু করে বয়ঃবৃদ্ধ মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে।
কী খাব? নিরাপদ কোনো খাবার আদৌ কী আছে?
মাছে ও দুধে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল, সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল, বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকস, জুস, সেমাই, আচার, নুডলস এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদারের রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ, পানিতে আর্সেনিক। ভেজাল খাবারের মাধ্যমে আমরা জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি, নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। কোথায় নেই ভেজাল? হাত বাড়িয়ে যা কিছু খাচ্ছি সবকিছুতেই ভেজাল। সারা দেশের মানুষের এখন একটি প্রশ্নÑ কী খাচ্ছি আমরা? শুধু খাদ্যপণ্য নয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এমনকি স্যালাইনও বাদ পড়ছে না ভেজালের নাগাল থেকে। ভেজাল হচ্ছে শিশুখাদ্য। নোঙরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য।
ইদানিং বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে তৈরি হচ্ছে টোস্ট বিস্কুট, বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল (আম, কলা, পেঁপে, আনারস ও অন্যান্য ফল), ক্ষতিকর রং দেওয়া ডিম, মেয়াদোত্তীর্ণ আইসক্রিম ও বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন, ডিডিটি দেওয়া শুঁটকি, ডিডিটি দেওয়া চাল, ক্ষতিকর রং দেওয়া ডাল, ভেজাল মিশ্রিত সয়াবিন তেল, সরিষা তেল, রং ও ভেজাল মেশানো ঘি, পামওয়েল মিশ্রিত কনডেন্সড মিল্ক, ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার সব খাবারেই যেন ঘাপটি মেরে আছে মৃত্যুদূত।
সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের চাষাবাদে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কীটনাশক নানাভাবে আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলছে। দেখা দিচ্ছে ফুসফুস ক্যানসার, লিউকেমিয়াসহ নানা ধরনের জটিলতা। দেশের ৭৫ভাগ কৃষক জানেন কীটনাশকে ক্ষতি হয়, তারপরও ফসল কম হবে এই আশঙ্কায় তারা কীটনাশক ব্যবহার করেন। বেশি লাভবান হওয়ার ইচ্ছাও কৃষককে কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহী করে তুলছে।
কীটনাশক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। কৃষক, খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তা কীটনাশক সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানার কারণেও এই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২৫ লাখ ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী ও ১৮টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া দেশে প্রায় ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীন প্রায় ১২০টি আইন ও নীতিমালা রয়েছে।
দেশে ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাদ্য ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগের পেশাগত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ নেই। সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য একটি জাতীয় প্রত্যাশা। দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে যেন সবাই সহজে ও সুলভ মূল্যে খাদ্য পেতে পারে, সেজন্য সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণীত হয়েছে। পাশাপাশি ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইনের বাস্তবায়নের জন্য নিরাপদ খাদ্যকর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। সর্বস্তরে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত আইন রয়েছে, নিরাপদ খাদ্যকর্তৃপক্ষ সেগুলো কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
৬৪টি জেলায় ও আটটি বিভাগীয় শহরে ৭৪টি নিরাপদ খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন মেনে চলার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানও পেশাজীবী নানা সংগঠনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বিধিমালাগুলো প্রণয়নের কাজ অব্যাহত রেখেছে।
নিরাপদ খাদ্য একটি কৌশলগত ব্যবস্থাপনা। এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। আমাদের শরীরে ৩৩ শতাংশ রোগ হওয়ার পেছনে রয়েছে ভেজাল খাদ্য। পাঁচ বছরের নিচে শিশুর ৪০ ভাগ রোগ হয় দূষিত খাদ্য থেকে। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানা পর্যায়ে দূষিত হয়। এর মূল কারণ অসচেতনতা। কৃষক বাজারজাত করার সময় খাদ্য দূষিত করে, ক্রেতা ভালো পণ্যের সঙ্গে ভেজাল পণ্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে খাদ্যের দূষণ ঘটায়। এই দূষণ রোধ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
উৎপাদনের পরিবেশ খাদ্যের মানকে প্রভাবিত করে। বাজারের তাজা মাছ কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, সেটি কিন্তু মাছের গুণগত মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। মাছকে যে খাবার দেওয়া হয়, তা থেকেও মানুষের শরীরে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এজন্য উৎপাদনের পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর করতে হবে। নতুবা ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যাবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করতে হবে। গবেষণার ফলের ভিত্তিতে করণীয় ঠিক করে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
শুধু আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, তার কার্যকর প্রয়োগও ঘটাতে হবে। নতুন আইন প্রয়োজন হলে সবকিছু বিবেচনা করে কার্যকর করতে হবে। কৃষককে নিরাপদ খাদ্য আইন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
পৃথিবীর প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। সর্বোপরি সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারি, বেসরকারি খাতসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য-ভেজাল প্রতিরোধে সরকার, ব্যবসায়ী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, শিক্ষক, গবেষক, গণমাধ্যম, বেসরকারি খাত ও কৃষকদের সম্পৃক্ত করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে এবং বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণে সকলকে আরও সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : সহকারী পরিচালক, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট