চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ধূমপান স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আপনি এবং আপনার শিশু

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ধূমপান না করেও আপনি এবং আপনার শিশুটি প্রতিনিয়তই মারাত্মক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে রয়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে জটিল কোন রোগে। একইসাথে শিশুদের আশপাশে ধূমপানের কারণে তারাও এর প্রতি উৎসাহিত হচ্ছেন বলেও গবেষণায় জানা যায়। এ বিষয়ে সকলকেই সচেতন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। গবেষকরা বলছেন, পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে নারীর ক্ষতির বিষয়টি গবেষকদের কাছে অত্যন্ত উদ্বেগের। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী এবং তাদের গর্ভের শিশুটিও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁঁকিতে থাকে।
ধূমপানের কারণে শিশুরাই যে আক্রান্ত হবে, বিষয়টি এমন নয় উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী ধূমপানের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ হৃদরোগ ও খুব দ্রুত সময়ে চোখের ছানিও পড়তে পারে যে কারোরই।
আর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গবেষণায় বলছে, সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া ও এতে মিশে থাকা বিষাক্ত উপাদান গর্ভস্থ শিশুর বুকে এবং হাতে রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়। ফলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হতে পারে।
গর্ভকালীন সময়ে কেউ যদি গর্ভধারিণীর আশপাশে ধূমপান করে অথবা পরিবারের কোন সদস্যও যদি ধূমপান করে থাকে, তাহলে গর্ভের সন্তানসহ মায়েরও ধূমপায়ীর মতো ঝুঁকি রয়েছে। এর জন্য যেকোন মুহূর্তে গর্ভের সন্তানের মৃত্যুও হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ঠোঁটকাটা এবং তালুকাটা সন্তান জন্মদানের হার অন্যদের তুলনায় বেশি। মায়েদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব স্পষ্ট শিশুর জন্ম-পরবর্তী সময়েও। স্বল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন শিশু, অমনোযোগী, অতি চঞ্চলতা, আচরণগত সমস্যা, লেখাপড়ার সমস্যার জন্যও দায় রয়েছে এর। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে হঠাৎ মৃত্যুও হতে পারে এসব শিশুর।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)- গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে বছরে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। তবে পরোক্ষ ধূমপানে বাংলাদেশে কতসংখ্যক শিশু ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
এদিকে স্পেনের এক গবেষণা দেখা গেছে, যেসব বাসায় ধূমপান করা হয় সেসব বাসায় শিশুদের অস্থিরতাজনিত মানসিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা ৩ গুণ বেশি। কেবল তাই- নয় ওইসব শিশুরা রীতিমত অন্যের সিগারেটের ধোঁয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
আর বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেট বা বিড়িতে ৭০ হাজার দূষিত পদার্থ রয়েছে। যা ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে, সেটা তো বাচ্চারা পাচ্ছে এবং ধোঁয়া ছাড়ার সময় যে সমস্ত জীবাণু ধূম্পায়ীর মুখে বা শ্বাসনালীর মধ্যে রয়েছে সেগুলো উনি ত্যাগ করছেন। সেগুলো ধোঁয়ার সাথে এসে বাচ্চার শ্বাসনালীতে সরাসরি চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে আগের চেয়ে ধূমপানের হার অনেক বেশি। দিনদিন অটিস্টিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চাও দেখা যাচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি। শিশুর মানসিক রোগ থেকে শুরু করে অপুষ্টি সবকিছুর পেছনেই রয়েছে ধূমপায়ীর সিগারেটের প্রভাব।
বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবি তাদের হাসপাতালে বেশ কয়েক বছর ধরে ভর্তি হওয়া শিশুদের বিশ্লেষণ করে পেয়েছে যে, যেসব শিশুর বাবা বাসায় নিয়মিত ধূমপান করে তারা তুলণামূলকভাবে বেশি অপুষ্টিতে ভোগে।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, গর্ভবতী থাকাকালীন অবস্থায় যদি মায়ের শরীরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিগারেটের ধোঁয়া যায়, তাতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশুর শ্বাসতন্ত্রের রোগ থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী ক্যান্সারের মতো জটিল সব রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিষয়টি আগে থেকেই সবার জানা থাকলেও নতুন ধারণা হচ্ছে শিশুটি প্রতিবন্ধী কিংবা অটিজমের আক্রান্ত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এর একমাত্র কারণেই হচ্ছে গর্ভাবস্থায় সিগারেটের ধোঁয়ার যোগসূত্র।
চিকিৎসকরা বলছে, পরোক্ষ ধূমপানে গর্ভস্থ শিশুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় গর্ভের প্রথম এবং শেষ তিন মাসে। এছাড়া গর্ভের পাঁচ মাসের মধ্যে যে কোন সময়ে ডিম্বাণু বের হয়ে যেতেও পারে। শিশু স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে কম ওজনের হতে পারে। অকালমৃত্যু সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হতে পারে। শিশুর বিভিন্ন বিষয় শেখার ক্ষেত্রে অথবা মনোযোগে সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুদের শ্বাসনালীর আকার অনেক ছোট। সেক্ষেত্রে ধূমপায়ীর ধোঁয়ায় শিশুদের শ্বাসনালী আর ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে তাদের সর্দিকাশি, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। দাঁতের ক্ষয়রোগ দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধূমপানের কারণে শুধুমাত্র শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা হবে, তাও নয়। বরং ধূমপায়ী অভিভাবকদের দেখে শিশুরাই ধূমপায়ী হয়ে ওঠে। ঘরে বসে থেকেই এসব শিশুরা তারই পরিবারের লোকজনের মাধ্যমে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (হোমিও ও ট্রাডিশনাল মেডিসিন) ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী পূর্বকোণকে বলেন, ‘ধূমপান থেকে পুরোপুরি দূরে থাকার চেষ্টা হলো উত্তম। তা সম্ভব না হলে বাসার বাইরে কিংবা আলাদা জোন ধূমপানের জন্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে সর্বোত্তম হচ্ছে ধূমপান থেকে বিরত থাকা। আমাদের জানা সত্ত্বেও আমরা ধূমপান অভ্যাসে পরিণত করে থাকি। কিন্তু এর জন্য নিজেরও অনেক ক্ষতি করছি, তা অনেকেই বোঝেন না’।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৬০ জন মানুষ মারা যায়। গ্লোবাল এডাল্ড ট্যোবেকো সার্ভের (গ্যাটস রিপোর্ট) তথ্য মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখমানুষ তামাকজাত পণ্য সেবন করে। পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয় আরো ৪ কোটি ৮ লাখ জন। তামাকের বহু মাত্রিক ক্ষতি উপলব্ধি করে বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং (ঝউএ) এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ৩য় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ডঐঙ ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ (ঋঈঞঈ) বাস্তবায়ন একটি অন্যতম কৌশল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝউএ এর আলোকে প্রণীত দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে দেশে ২০০৫ সালে আইন প্রণয়ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এত উদ্যোগের পরও যেন থমকে আছে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। এমনি শতভাগ পাবলিক প্লেস হিসেবে চিহ্নিত হাসপাতাল ক্লিনিক সমূহতেই প্রতিপালন হচ্ছে না তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন।
২০১৭ সালে গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকোসার্ভে (গ্যাটস) অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিভাগে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে ২০.১% পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় তামাকনিয়ন্ত্রণ আইন প্রতিপালনের অবস্থা সম্পর্কিত এক জরিপ পরিচালনা করে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইপসা। গত বছরের জুন মাসে পরিচালিত এই জরিপের ফলাফল বলছে, চট্টগ্রাম শহরের ৩৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে ধূমপানের চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সরাসরি ধূমপান করতে দেখা গেছে ১৪.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। ২৭.৩ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। ১৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ভবনের বাহিরে কিন্তু সীমানার মধ্যে ধূমপান করতে দেখা গেছে। ৯৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সতর্কতা মূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ৬৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কোন ধরনের সতর্কতা মূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে, ২ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভবনের ভেতরে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে, ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভবনের বাহিরে কিন্তু সীমানার মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে, ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সীমানার মধ্যে ভ্রাম্যমান বিক্রেতাকে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র পাওয়া গেছে।
উন্নত দেশের অনেক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে ভর্তি ফরম বা ছাড়পত্রে কিংবা লিফলেট প্রদান করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে মাত্র ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কিত বার্তা দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ইপসার উপ পরিচালক নাছিম বানু বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র শতভাগ ধূমপান মুক্ত। কিন্তু আমাদের জরিপ বলছে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে তামাক ব্যবহারের হার আশঙ্কাজনক। ফলে সেবা নিতে গিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন রোগী ও রোগীর স্বজনরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের উপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ জরুফর বলে মনে করি।’

লেখক ঁ নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট