চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি

পরিচ্ছন্ন কর্মীদের অমানবিক জীবন

আশহাবুর রহমান শোয়েব

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

শহরের আবর্জনা পরিষ্কার করে তা দুর্গন্ধমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর রাখতে সহায়তা করলেও চরম স্বাস্থ্য- ঝুঁকিতে রয়েছে নগরীর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। কোন প্রকার সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই সনাতন পদ্ধতিতে দিনের পর দিন রাস্তার ময়লা আবর্জনা থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার, গভীরকূপ ও সেপটিক ট্যাক খালি করা এবং সুয়ারেজ লাইন ও ম্যানহোল পরিষ্কার করছে তারা। যার কারণে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন এসব পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। শুধু তাই নয়, দুর্বিষহ অবস্থায় কাটছে তাদের জীবন।
এ যেমন নগরীর বান্ডেল রোডের এক সময়কার মেথরপট্টি। যাকে এখন বলা হয় সেবক কলোনি। অনেকে চেনেন হরিজন পল্লী নামে। এখানে বসবাস করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ৩শ পরিবার। ছোট ঘরে জায়গা হয় না বিধায় অনেকেই নিজ সন্তানকে রাখেন নিকটাত্মীয়ের বাসায়। ছোট্ট ঘরে খাট পাতলে আলমারি পাতার জায়গা থাকে না। আলমারি পাতলে টেবিল রাখার জায়গা হয় না। টেবিল রাখলে থাকে না রান্নার জায়গা। এমনই দুর্বিষহ অবস্থায় কাটছে তাদের জীবন। জীবন সংগ্রামে তাদের এ যুদ্ধ যুগ যুগ ধরে। এখনো অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই।
হরিজন সম্প্রদায়ের এসব মানুষ কাজ করেন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে। সেখানেও পান না কাজের উপযুক্ত পরিবেশ। তাদের অভিযোগ কাজের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। কাজের সময় গ্লাভস, মাস্ক, বিশেষ জুতো পাওয়ার কথা থাকলেও তা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। তাই কোনো রকম সুরক্ষা ছাড়াই ময়লার ভাগাড়ে কাজ করতে হয় তাঁদের। ফলে অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। শহরের আবর্জনা পরিষ্কার করে তা দুর্গন্ধমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর রাখতে সহায়তা করলেও নিজেরাই পতিত হন চরম স্বাস্থ্য-ঝুঁকিতে। ময়লা আবর্জনার মাঝে কাজ করতে হয় বলে ফুসফুস, হার্ট, কিডনি ও চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন তারা।
চিকিৎসকদের মতে, ময়লা আবর্জনার মাঝে কোনো প্রকার সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া এভাবে কাজ করলে হতে পারে নানা জটিল রোগ। এমনকি ক্যান্সারের আক্রান্ত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ময়লার ভাগাড়ে নানা বস্তুতে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আহত হতে পারেন। যা থেকে শরীরে প্রবেশ করতে পারে ভয়ংকর জীবাণু। অথচ দিনের পর দিন খালি হাত-পায়ে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন ময়লার ভাগাড়ে। আবার অসুখ হলেও চিকিৎসা সেবা পান না তেমন। সেখানেও নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে অকালেও অনেক প্রাণ ঝরে পড়ে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়াটার এইড, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর যৌথ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট লাখ সুইপার রয়েছে, যারা দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে এবং প্রায়শই কোনো সরঞ্জামাদি ও কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্যানিটেশন শ্রমিকদের বিপজ্জনক কর্ম পরিবেশের মাঝে কাজ করতে হয়, যা তাদের স্বাস্থ্য এমনকি জীবনের জন্য মারাত্মকভাবে ঝুঁঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে ২০১৮ এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় পরিচ্ছন্নতা-কর্মীদের ২০ ভাগেই ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। এর বাইরে এজমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন ২৩ ভাগ পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
এছাড়াও এ সম্প্রদায়ের আবাসস্থলগুলোতেও রয়েছে নানা অসুবিধা। ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। যা অস্বাস্থ্যকর। এভাবে বসবাসের ফলে একজনের কোনো অসুখ অর্থাৎ ছোঁয়াছে রোগ হলে দ্রুতই তা সংক্রমিত হয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মাঝে। ছোট্ট একটি কক্ষে অত্যধিক মানুষের বসবাসের ফলে অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দ্রুত। এতে ছড়িয়ে পরে রোগ-জীবাণু। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় ভুগতে হয় নানা সমস্যায়। রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যাও। স্বল্প-আয়ের এসব মানুষ কোনোমতে জীবন ধারণ করছেন নগরীর চারটি হরিজন পল্লীতে।
নগরীর বান্ডেল রোড, ঝাউতলা, ফিরিঙ্গী বাজার ও মাদারবাড়ি এলাকায় বসবাস হরিজন সম্প্রদায় এলাকায় গিয়ে সবখানের একই চিত্র দেখা গেছে। ১০ ফুট বা তারচেয়ে সামান্য বড়-ছোট একটি রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয় ৫ থেকে ৭ জনের একেকটি পরিবারকে। বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক নাগরিক সুবিধা থেকেও। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ে এখনো পিছিয়ে এ সম্প্রদায়ের মানুষ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের যৌন ও চর্মরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রফিকুল মাওলা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য পরিষ্কার কাজে নিয়োজিত থাকলে ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। একজিমা, চুলকানিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা সমস্যাও হতে পারে। কাজ শুরু করার আগে তাদের অবশ্যই গ্লাভস, মাস্ক এবং বুটজুতা ব্যবহার করতে হবে। কাজ শেষে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত-মুখ পরিষ্কার করতে হবে। আর শিশুদের জন্য এই কাজটি মারাত্মক খতির কারণ হতে পারে।
এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময় পর মেডিকেল চেকআপ করা দরকার বলেও মনে করেন এ চিকিৎসক। যদিও গ্লাভস বা মাস্কতো থাক দূরের কথা ঠিকমতো উপযুক্ত সরঞ্জার না পাওয়ার অভিযোগ প্রায় সকল পরিচ্ছন্নতা কর্মীর।
বাবু দাশ নামের একজন জানালেন, ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন তারা। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় এক সন্তানকে রাখতে হচ্ছে আত্মীয়ের বাসায়। ছোট্ট একটি কক্ষে পরিবার নিয়ে বসবাস অসম্ভব হলেও বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে তাঁদের। কাজের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সরঞ্জার না পাওয়ার অভিযোগ প্রায় সবার।
যদিও সিটি কর্পোরেশন বলছে, সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হলেও পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তা ব্যবহার করেন না অভ্যাসগত কারনেই। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে কর্মীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
তবে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ না করে হরিজন সম্প্রদায়ের এসব মানুষগুলোর সুস্থ ও সুন্দর জীবন নিশ্চিতে সকলে কাজ করবেন বলে প্রত্যাশা সবার।

মানবেতর জীবনযাপন করা এসব মানুষগুলো অন্য দশজনের মতই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেঁচে থাকবেন, তাঁদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বেড়ে উঠবে একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সেটিই নিশ্চিত করতে হবে সবার।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, ‘সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া কাজ করা উচিত নয়। এসব কিছু ব্যবহার করা অবশ্যই উত্তম। শুধু যে অসুখ-বিসুখ হবে তাও নয়। বরং ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে গিয়ে বিভিন্ন কারণে ছোট-খাট দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। কেননা ড্রেন কিংবা রাস্তায় অথবা ময়লার ভাগাড়ে বিভিন্ন ধরণের বস্তু থাকতে পারে। কাচ থেকে শুরু করে ধারলো পদার্থও থাকার সম্ভাবনা আছে। এসব বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।’
এসব সেবকদের জন্য সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক সবসময় সেবা কার্যক্রম খোলা থাকে। তাদের জন্য পৃথকভাবে হেলথÑক্যাম্পও রয়েছে। যেখানে তারা চিকিৎসকের পরামর্শসহ ওষুধও গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের সকল হাসপাতালেই তাদের বিনাপয়সায় চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে। অনেকেই সেবা নিতে আসেন। আবার অনেকেই আসেন না। সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ সবসময় তাদের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে নজরে রাখেন বলেও জানান তিনি’।
লেখক : সংবাদকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট