চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চিকিৎসা সেবা বাড়ছে ভারত ভরসা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাইসের অপারেশন করিয়েছেন বোয়ালখালী উপজেলার এক তরুণ ব্যবসায়ী। ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতাল থেকে একই অপারেশন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা। দুই জনকেই ভারতের চেন্নাই গিয়ে দ্বিতীয়বার একই অপারেশন করতে হয়েছে। মাঝখানে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় আর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাদের।
শুধু ওই কর্মকর্তা নয়, সাধারণ অনেক মানুষই চিকিৎসার জন্য ছুটছেন ভারতে। প্রতিবছর ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ভারতের সরকারি হিসাবে দেখা যায়, দেশটিতে চিকিৎসা সেবা নেয়া প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন হচ্ছেন বাংলাদেশি।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ছুটে যাচ্ছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বেশির ভাগই ভারতের চেন্নাই, ভেলোর, বেঙ্গালুরু ও কলকাতায় চিকিৎসা নেয়। এছাড়াও দিল্লী ও হায়দ্রাবাদেও যাচ্ছেন অনেকেই। সহনীয় খরচে উন্নত চিকিৎসার আশায় বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারত-নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। জটিল ও কঠিন রোগ ছাড়াও সামান্য রোগের জন্যই ভারতে ছুটে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। প্রতি বছর শত কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ভারতে। ভারতগামী পর্যটকের মতো চিকিৎসা খাতও এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এই সুযোগে বাংলাদেশি রোগীদের টানতে ভিসা পদ্ধতি সহজ করেছে ভারত সরকার।
ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে ভারতে গেছেন এক লাখ ৩৫ হাজার ১৮৪ জন। এরমধ্যে মেডিকেল ভিসা নিয়েছেন ২৪ হাজার ২২০ জন বাংলাদেশি নাগরিক। ২০১৬ সালে গিয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৪ জন। এরমধ্যে মেডিকেল ভিসায় গেছেন ৪২ হাজার ৮২১ জন। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে ভারতে গেছেন এক লাখ ৬০ হাজার ১৭৯ জন। এরমধ্যে চিকিৎসা ভিসা নিয়েছেন ৫১ হাজার ৮০৯ জন। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে ভারতীয় ভিসা নিয়েছেন এক লাখ ৮৯ হাজার ২৫২ জন। এরমধ্যে চিকিৎসা ভিসা নিয়েছেন ৭০ হাজার ৫৩৩ জন। সবচেয়ে বেশি ভিসা নিয়ে ভারতগমন করেছে গতবছর। ২০১৯ সালে ভিসা নিয়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজার ৭৩৩ জন। এরমধ্যে মেডিকেল ভিসা নিয়েছেন ৭৪ হাজার ৩৫৬ জন। গত ৫ বছরের ব্যবধানে ভারত গমন বেড়েছে ৯৫ হাজার ৫৪৯ জন। অর্থাৎ ভারতগমনের হার বেড়েছে ৭০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ভারতগামীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চিকিৎসা ভিসার হার। ৫ বছরের ব্যবধানে চিকিৎসা ভিসায় ভারতগমন বেড়েছে ৪৭ হাজার ১৩৬ জন। অর্থাৎ মেডিকেল ভিসার হার বেড়েছে ১৭৩ দশমকি ১৬ শতাংশ।
চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার কার্যালয়ের সেকেন্ড সেক্রেটারি সুভাশীষ সিনহা বলেন, ভারতীয় ভিসা প্রক্রিয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। বিশেষ করে চিকিৎসা সংক্রান্ত ভিসার ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিষয়ক কাগজপত্র ঠিক থাকলে দ্রুত ভিসা পাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এমনকি জটিল রোগের ক্ষেত্রে একদিনের মধ্যেও ভিসা প্রদান করা হচ্ছে।
তাঁর আড়াই বছরের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা সহজতর করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে এসব কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত আবেদন নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে চট্টগ্রামে এখন আর দীর্ঘলাইন ধরতে হয় না। খুবই সহজেই ভিসা পাচ্ছেন। এছাড়াও নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের নাগরিকদের দু’একদিন আগে চট্টগ্রামে আসতে হচ্ছে না। ওই অঞ্চলের মানুষ নিকটস্থ ভিসা কেন্দ্রে আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন।
গত বছর চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিকবার ভারতের বেঙ্গালুরুতে অবস্থানকালে দেখা যায়, রোগীদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। শুধু উচ্চবিত্ত নয়, মধ্য ও নি¤œবিত্ত মানুষও চিকিৎসা নিচ্ছেন ভারতে। এরমধ্যে ক্যান্সার, কিডনি, হার্টের মতো জটিল রোগী যেমন রয়েছে, আবার সামান্য রোগের কারণেও ভারতে ছুটে যাচ্ছেন অনেকেই।
নগরীর হালিশহর এলাকার কামাল উদ্দিন মা, স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে গেছেন বেঙ্গালুরুতে। কামাল উদ্দিন বলেন, আড়াই বছর আগে হার্টের বাইপাস সার্জারি করেছেন ভারতে। চেকআপ করাতে ভারতে যেতে হয়। নিজের ছাড়াও মায়ের কিডনি রোগের চিকিৎসাও করান সেখানে।
বেঙ্গালুরুর বিখ্যাত নারায়ণা ইন্সটিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়িন্সেস হাসপাতালে ( ডা. দেবী শেঠীর হাসপাতাল নামে অধিক পরিচিতি) রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশি। বাংলাদেশি রোগীদের রেজিস্ট্রেশন বা চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আলাদা বুথ রাখা হয়েছে। এখানে ভিসা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সংক্রান্ত সব বিষয়ে বাংলা ভাষায় পরিসেবা দেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স-আয়দের সবাই হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। আবার নিজের মধ্যে বেঙ্গালুরুর আঞ্চলিক ভাষা কর্ণাটকি ভাষায় কথা বলেন। তবে বাংলা ভাষাভাষিদের ভাষা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের জন্য বাংলায় পরিবেসার সুযোগ রাখা হয়েছে। তাই চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে ভাষা সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। স্বাচ্ছন্দ্যে বাংলা ভাষায় চিকিৎসা করানোর সুবিধা রয়েছে।
ভারতের ভেলুরে টানা দুই মাস অবস্থান করে ভাগ্নে শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ’র চিকিৎসা করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইরি বাসিন্দা শেখ মুহাম্মদ আকিজ। ভাগ্নে নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।
শেখ মুহাম্মদ আকিজ বললেন, ভাগ্নে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় অতিরিক্ত ঘুম, ঝিমুনীসহ শরীরে নানা উপসর্গ সৃষ্টি দেখা দেয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ‘সিজোফ্রেনিয়া’ নামক রোগ নির্ণয় করা হয় বাংলাদেশে। শুরু হয় সেই রোগের চিকিৎসা। কিন্তু ওষুধ সেবনের পর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে শেখ আবদুল্লাহ। শরীর নতুন করে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। শেষে ওষুধ সেবন বন্ধ করে ছুটে যান ভারতের ভেলোরে। চিকিৎসা শুরু করেন একটি মিশনারী হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা নির্ণয় করলেন ‘সিজোফ্রেনিয়া’ নয়, মানসিক দুর্বলতায় অনেকটা ‘আচরণগত’ রোগে ভুগছিল আবদুল্লাহ। এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে ওষুধের বদলে মানসিক চিকিৎসা। কোন কাজে তাকে উৎসাহ দেওয়া, সাহজ যোগানো ও কাজের প্রতিদান হিসেবে পুরস্কার প্রদান করা। যাকে বলা হয় ‘অকুপেশনাল থেরাপি’। দেড় থেকে দুই বছর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠার আশ্বাস দিয়েছেন ভেলুরের চিকিৎসকেরা।
স্ত্রী, ছেলে-সন্তানসহ ১৪ জনের বহর নিয়ে ভারতের বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসা নিতে গেছেন রশিদ আহমদ। তিনি জানান, নিজের ছেলে ও বড় ভাইয়ের মেয়ের চিকিৎসা করান ভারতে। ভেলোর ও বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসা নিতে কোনো ধরনের হয়রানি বা দালালের খপ্পরে পড়তে হয় না। অযথা টেস্টের (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) ঝামেলামুক্ত পরিবেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুবিধা রয়েছে।
বাংলাদেশি রোগী ও স্বজন অভিমত, আস্থা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, ব্যবহার এবং রোগ নির্ণয়ে অনেকটা সন্তুষ্ট। এসব কারণে বাংলাদেশি রোগীদের ভারত নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ডায়াগনস্টিক সংক্রান্ত বিষয়ে আস্থা বাড়ছে। চিকিৎসার নামে হয়রানির শিকার হতে হয়নি। একই ডায়াগনস্টি একাধিকবার করানো হয় না। চিকিৎসকরা রোগীকে যথেষ্ট সময় দেন। রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে রোগের বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। যাতে সন্তুষ্টি নিয়ে দেশে ফিরেন বাংলাদেশিরা। এছাড়াও চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচও বাংলাদেশের তুলনায় অনেকটা কম। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের নিয়েও দুশ্চিতায় থাকতে হয় না। চিকিৎসক, নার্স ও আয়াদের আচরণে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন রোগী-স্বজনেরা।
ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার অরিন্দম ব্যানার্জি বলেন, বাংলাদেশ ভারতের পাশ্ববর্তী ও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র। আমরা বাংলাদেশ ভালবাসি। বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার মান অনেক অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশেষ করে মাতৃত্বসেবা, শিশু চিকিৎসা ও গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবায় অনেক উন্নতি হয়েছে। তারপরও জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতে অনেকেই ভারতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ভারতের চিকিৎসাসেবার মান বিশ্বে সমাদৃত। বাংলাদেশি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা ভারতে চিকিৎসা নেয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয় অনেকটা নাগালের মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া ওষুধের গুণগতমানের তো কোনো প্রশ্নই নেই।
তিনি আরও বলেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা রয়েছে। তাই বাংলাদেশিদের জন্য চিকিৎসা ছাড়াও পর্যটন, ব্যবসায়ী ভিসা প্রক্রিয়া অনেক সহজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে চেন্নাই সরাসরি বিমান চলাচল শুরুর পর চিকিৎসা ভিসার চাহিদা আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। এছাড়াও আগরতলা স্থলবন্দর দিয়েও যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ভারতে ট্রেনসার্ভিস চালু করা হলে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগক্ষেত্র আরও সহজ হবে। ট্রেনে ইমিগ্রেশন সিস্টেম রেখে সরাসরি ট্রেন সার্ভিসের দাবি চট্টগ্রামবাসীর।
সহকারী হাই কমিশনার অরিন্দম ব্যানার্জিও সরাসরি ট্রেন সার্ভিস চালুর পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব কমার্শিয়াল ইন্টেলিজেন্স এন্ড স্ট্যাটিস্টিকস (ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চার লাখ ৬০ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তারমধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজার হচ্ছেন বাংলাদেশি। এছাড়াও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি নাগরিক মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারতে গেছেন। যা ২০১৬ সালে ভারতগামী চিকিৎসা ভিসার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশে একটি হাসপাতালকে ঘিরে গড়ে ওঠে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল। এই ফাঁকে গড়ে ওঠে অনুনমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা দেখলেই বুঝা সেই চিত্র সহজেই অনুমেয়। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা গেছে ভারতে। কোনো নামি-দামী হাসপাতাল এলাকায় হাজার হাজার রোগীর সমগম থাকলেও নেই যত্রতত্রভাবে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালের নিজস্ব ল্যাবেই করানো হয়। তবে ওষুধের দোকান রয়েছে। তাও বাংলাদেশের মতো নয়, হাতেগোনা কয়েকটি। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধপত্র ও ইনজেকশন সংরক্ষণ করা হয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়। তবে হাসপাতাল ঘিরে ভুঁইফোঁড় ল্যাব-ওষুধের দোকান না থাকলে রয়েছে বহু আবাসিক হোটেল-লজ। যাতে নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

লেখক ঁ নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট