চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিকিৎসা-ব্যয় কীভাবে কমাতে হবে

চিকিৎসা শ্রমিকের দিনলিপি

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সেবা নেয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। ব্যক্তির নিজস্ব খরচের ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ যায় ওষুধ কিনতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ৮ দশমিক ২ শতাংশ, হাসপাতালে যায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ, চিকিৎসকদের পেছনে খরচ হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে খরচ হয় ৫ দশমিক ২ শতাংশ (প্রথম আলো, ০৪-০২-১৯)।’
উল্লিখিত সংবাদচিত্রটি বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, বর্তমানে চিকিৎসা ব্যয় যে হারে বেড়ে চলেছে সেটা আপামর জনসাধারণের আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছে। জনস্বার্থে সহনীয় পর্যায়ে থাকা উচিত চিকিৎসা ব্যয়। এ পরিস্থিতির প্রকৃত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কেন চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে চলেছে? এর সমাধান কীভাবে হবে? এ ব্যাপারে চিকিৎসকের দায় কতটুকু? বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দায় কতটুকু? ওষুধ শিল্পের দায় কতটুকু? রাষ্ট্রের দায় কতটুকু?
সংবাদচিত্রটিতে বিশ্লেষণের উপাত্তসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ওষুধ, হাসপাতাল বেড, রোগনিরূপণী এই তিনটি খাতের ব্যয় কমিয়ে আনতে পারলে মোট চিকিৎসা ব্যয় অন্তত শতকরা ৩০ ভাগ কমে আসবে এবং এ টাকা আপামর জনসাধারণেরই সাশ্রয় হবে। এ কাজটুকু সম্পন্ন করার দায়িত্ব শুধুমাত্র চিকিৎসকদের ওপর চাপিয়ে দিলে সেটা অযৌক্তিক হবে। কেননা, এ পরিস্থিতির জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী হচ্ছে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীগণ ও রোগনিরূপণী যন্ত্রসমূহের আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারক বহুজাতিক পুঁজিপতিদের সীমাহীন মুনাফালোভী মনোভাব। ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করা যাক।
রোগীদের চিকিৎসা অর্থনৈতিক অবস্থা : বাংলাদেশে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হয়। দক্ষিণ এশীয়ভুক্ত অন্যান্য দেশে এই হার কম। মালদ্বীপ ১৮ শতাংশ, ভুটান ২৫ শতাংশ, নেপাল ৪৭ শতাংশ, পাকিস্তান ৫৬ শতাংশ, ভারত ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশে বাৎসরিক পারিবারিক চিকিৎসা ব্যয় ১৮-৪০ হাজার টাকা। বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে বাৎসরিক ব্যয় সরকারের ১০,২০০ কোটি টাকা এবং জনগণের ৩০,২০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি ব্যয় সর্বনি¤œ এবং ব্যক্তিগত ব্যয় সর্বোচ্চ। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি ব্যয় ভারতে ৩৩ শতাংশ, নেপালে ৪০ শতাংশ, বাংলাদেশে ২৩ শতাংশ। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তিগত ব্যয় ভারতে ৫৭ শতাংশ, নেপালে ৪৯ শতাংশ, বাংলাদেশে ৬৩ শতাংশ।
দেশে জিডিপি এর আকার বাড়লেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমেছে : বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি এর কমপক্ষে ৫ শতাংশ ব্যবহার করা উচিত। সে অনুযায়ী এ বছরের ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া উচিত ছিলো ১২৬৮০৮ কোটি টাকা। কিন্তু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২৫৭৩২ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমছে : ২০০৮-৯ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মোট বাজেটের ৫.৭ শতাংশ ছিলো। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ছিলা ৫.১৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ছিলো ৫.০৩ শতাংশ। এ বারের ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৯১ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে থাকে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে কারা সুযোগ নিচ্ছে ?
স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে প্রাইমারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তার ফলশ্রুতিতে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি স্বাস্থ্যখাত রোগীদের অত্যধিক চাপে নিষ্পেশিত হয়ে পড়েছে। ফলতঃ সরকারি হাসপাতালে বহিঃর্বিভাগ বা আন্তঃবিভাগ কোথাও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে রোগীরা বেসরকারিতে অর্থাৎ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভিড় করছেন। এই ভিড় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় খোলা বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী বেসরকারি চিকিৎসাসেবা অনেক বেশি মূল্যে অসহায় রোগীরা কিনতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সুযোগটা নিয়েছে হাসপাতাল ব্যবসায়ী, রোগনিরূপণী ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসা ব্যবসায়ীগণ। উল্লিখিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশির ভাগই অচিকিৎসক ক্ষমতাবান পুঁজিপতি।
এই সুবিধা ভোগীদের কারা সহযোগী? : এদের সহযোগী হচ্ছেন দুর্নীতিবাজ আমলারা। কারণ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মেধা-মননগত দিক দিয়ে চিকিৎসকরাই মূল নির্দেশক-এটা সাদামাঠাভাবে বলা গেলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক কিন্তু চিকিৎসকরা নন এটা বাস্তব সত্য। আমলা-নির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমলারাই চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করেন। আর খোলাবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীরাও চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করেন। আমলা এবং ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার নির্যাসটুকু নিয়ে নিজেরা লাভবান হন, কিন্তু এর দায়টুকু অসহায় চিকিৎসকদের উপর চাপিয়ে দেন।
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চিকিৎসকরা কেন অসহায়?
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চিকিৎসকরা অসহায় এ কারণে যে, সেবাদানকারী হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদেরকে সরকারীি পর্যায়ে আমলাদের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করতে হয় এবং বেসরকারি পর্যায়ে সেবাদানকারীদের সেবাকর্মের ভুলত্রুটির দায়ভার যেমন চিকিৎসকদের নিতে হয় তেমনি মেডিকেল যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ীদের যথেচ্ছাচারী মুনাফার অর্থ জোগানের দায়ভারও চিকিৎসকদের বহন করতে হয়। তাই দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বেড স্বল্পতার কারণে রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা হলে রোগী সেটা চিকিৎসকদের ইচ্ছাকৃত অবহেলা হিসেবে ধরে নেয়। আবার বেসরকারি হাসপাতালে সেবাদানকারীদের গাফিলতি বা রোগনিরূপনী যন্ত্রের ত্রুটির কারণে চিকিৎসার কোন ভুলত্রুটি হলে রোগী সেটা চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি হিসেবে ধরে নেয়। এমনি ক্ষেত্রে রোগীর কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিঃসন্দেহ হবার উদ্দেশ্যে পুনরায় করার প্রয়োজন হলে রোগী ভ্রান্তবশত সেটাকে চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক প্রবণতা হিসেবে ধরে নেয়। বলাবাহুল্য, সেবাদানকরীগণ ও রোগ নিরূপণী যন্ত্র সংশ্লিষ্ট সেবাকর্মীগণ তাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করেন হাসপাতাল ব্যবস্থাপক ও চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের নিকট, চিকিৎসকদের নিকট নয়। উপরে বর্ণিত পরিস্থিতির আলোকে দেখা যাচ্ছে যে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিবিধ সমস্যাদি সৃষ্টির জন্য শুধুমাত্র চিকিৎসকদের পেশাগত অবহেলাই দায়ী থাকে না, বরং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি ও ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের অধিকতর মুনাফালোভী মনোভাবই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী থাকে। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে সরকার জনগণের কাছে প্রচারণা পাবার জন্যে শুধুমাত্র চিকিৎসকদের দায়ী করে বিবিধ বুলি আউড়ে থাকে। কারণ নির্বাচনী কৌশল করায়ত্ত করার জন্য আমলাদের এবং বৃহদাকার নির্বাচনী ব্যয় জোগানোর জন্য ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন সরকারের কাছে বেশি থাকে। সারমর্ম হিসেবে বলতে চাই যে, চিকিৎসা প্রদান করা চিকিৎসকদের নৈতিক দায়িত্ব এবং চিকিৎসা পাওয়া জনগণের মৌলিক ন্যায্য অধিকার এ কথাটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্য যে, চিকিৎসাব্যয় জনগণের সহনীয় পর্যায়ে থাকলেই কেবল চিকিৎসা সেবা জনগণের কাছে সহজলভ্য হতে পারবে।
এবারে নীচের সংবাদচিত্র দুটির প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
(১) ‘জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সরঞ্জাম বা সামগ্রীর বাজারে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমদানীকারকরা যে যার মতো করে মূল্য নির্ধারণ করে তা বিক্রি করছে। আর এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। আবার কৃত্রিম সংকটা সৃষ্টি করেও হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের মুনাফা। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে বাংলাদেশের বাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল ও ইলেট্রনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়। এ সব চিকিৎসা সামগ্রীর বাজারের উপর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সূত্রমতে, রোগনির্ণয়, প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ সারাতে ব্যবহৃত প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশী আইটেমের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছে। সরকারীিভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় আমদানিকৃত এ সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বাজারে যুক্তিসংগত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে (প্রতিদিনের সংবাদ, ২৭/৫/১৭)।’
(২) ‘সিজারিয়ান অপারেশনের হারের বৃদ্ধি-দেশে সিজিরিয়ান নবজাতক প্রসবের হার ২০০৪ সালের ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ২৩ শতাংশে পৌছায় (টিআইবি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ৭/২/১৮)’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট