চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চমেক রোগীকল্যাণ সমিতি শুধু সেবা নয়, পুনর্বাসনও

ইমাম হোসাইন রাজু

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

মাহবুবুল আলম। প্রতিদিনের মতই টমটম গাড়ি চড়ে যাচ্ছিলেন নিজ কাজে। কিন্তু মাঝপথে সেই গাড়ি উল্টে মারাত্মক আহত হন কক্সবাজারের এ বাসিন্দা। তাতেই হারিয়ে ফেলেন হাঁটা-চলার শক্তি। হয়ে পড়েন পঙ্গুত্ব। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে হুইল চেয়ার ব্যবহার করে চলাফেরা শুরু করেন মাহবুব। তবুও তিনি থেমে নেই জীবন সংগ্রামে। হুইল চেয়ারে বসেই নিজ এলাকায় পরিচালনা করছেন ছোট্ট একটি দোকান। যার আয়ে চলছে মাহবুবের জীবন সংসার। পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন তাদের ভরণপোষণও।
তার এই স্বপ্নের কারিগর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে অবস্থিত রোগীকল্যাণ সমিতি। এই সমিতি ও সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতায় চিকিৎসা থেকে শুরু করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে মাহবুবুল আলমের। তিনি হুইল চেয়ারে বসে তার দোকান পরিচালনা করছেন এবং নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। একসময়ের স্বপ্নহীন সেই মাহবুব বর্তমানে দিন-যাপন করছেন অন্য দশ জনের মতোই।
তার মতো চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর মোহাম্মদ শফিক। গাছের ডাল কাটতে গিয়ে পড়ে গুরুত্বর আহত হন তিনিও। চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন এনজিও এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা শোধ করতে হিমশিম খেতে হয় এই দিনমজুর পরিবারের। কিছু ঋণ পরিশোধ করলে অর্ধেকের চেয়ে বেশি অংশই দিতে ব্যর্থ হয় তারা। তাদেরও এমন দুর্দশার চিত্র জানার পর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রোগীকল্যাণ সমিতি।
শুধু রোগীদের চিকিৎসাই নয়, অস্বচ্ছল রোগী পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে আসছে এ সেবা সমিতি। পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগীদের সেবায় নিয়মিত সরঞ্জামসহ সহযোগিতা করে আসছেন তারা। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপতাালে প্রতিষ্ঠিত রোগীকল্যাণ সমিতি গত ৫৭ বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ হতদরিদ্র রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছে।
এর বাইরেও চমেক হাসপাতালে আগত অসহায়, পীড়িত, দুঃস্থ, দরিদ্র ও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন রোগীরা যাতে চিকিৎসা সেবা যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য পরামর্শ দিক নির্দেশনা এবং মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত গরীব অসহয় রোগীদের ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী চশমা ও লেন্স রক্ত হুইলচেয়ার, ক্র্যাচ, কৃত্রিম অংঙ্গ, শীতবস্ত্র, যাতায়াত, এম্বুলেন্স ভাড়া প্রভৃতি সাহায্য দিয়ে আসছে এ সমিতি। যা হাসপাতালে সবার কাছে পরিচিতি এক নাম ‘দুঃস্থদের রোগীকল্যাণ’।
রোগীকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হাসপাতাল সমাজসেবা অফিসার অভিজিৎ সাহা বলেন, ‘আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সমস্ত রোগীর দায়দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিতে পারে না। যেহেতু হাসপাতালে আসা অস্বচ্ছল রোগী ও পরিত্যক্ত শিশু যাদের কোন অভিভবক থাকে না, তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে রোগীকল্যাণ সমিতি। পাশাপাশি সমিতির সদস্যদের সহযোগিতায় আমরা নতুন করে অস্বচ্ছল পরিবারের সদস্যকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের মাহবুবুল আলম নিজ গ্রামে একটি ছোট্ট দোকান করে পরিবারেরর ভরনপোষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া শফিকের সকল ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে তাও সমিতির সদস্যদের সহযোগিতায়।’
চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জামেও রোগীকল্যাণ সমিতির অবদান : শুধু অস্বচ্ছল কিংবা দুঃস্থ রোগীদের সেবায় এই সমিতি কাজ করছে না। বরং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আগত রোগীদের শতভাগ সেবা পৌঁছে দিতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন এই সমিতি। সমিতির সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছেন তারা। দিয়ে যাচ্ছেন রোগীদের সেবাও। সম্প্রতি চমেক হাসপাতালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হৃদরোগ বিভাগে নতুন করে যোগ ১৫টি করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) শয্যার ব্যবস্থা করেছেন সমিতি। চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুদানে ১৫টি শয্যার মনিটর, বেড, এসি ও আনুসাঙ্গিক ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। যার সবগুলোই ব্যবস্থা করেছে হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতি। এছাড়া এই বিভাগে ইসিজি মেশিনের ব্যবস্থাও করেছে তারা।
এর বাইরে রোগীকল্যাণ সমিতির তত্ত্বাবধানে হৃদরোগ বিভাগে হেল্প ডেস্ক স্থাপন, বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী বিভাগের বারান্দায় থাই গ্লাস স্থাপন। শিশু ওয়ার্ডে নিয়মিত কম্বল প্রদান, নবজাতক ওয়ার্ডে রের্পি টাওয়াল, নেবুলাইজার মেশিন, সাকসান টিউব ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি প্রদানসহ হুইল চেয়ার কিংবা স্টেচারের এবং থোরাসিক সার্জারি বিভাগে আড়ই লাখ টাকার যন্ত্রাপতির ব্যবস্থাও করেছে এ সমিতি। এছাড়া সার্জারি বিভাগের একজন ওটি বয়ের এক বছরের বেতন, রেডিওথেরাপী বিভিগের একজন টেকনিশিয়ান এবং মানসিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিচর্যার জন্য দুই জন আয়ার এক বছরের বেতন প্রদানের ব্যবস্থাও করেছেন রোগীকল্যাণ। একই সাথে গাইনি বিভাগে কলনকোস্কপ মেশিন, দুটি লেবার (প্রসব) টেবিল, ফ্লোর টাইল্সসহ নানান কাজেও অবদান রেখেছেন তারা।
রোগীদের সেবায় সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ সাহা পূর্বকোণকে বলেন, ‘এ সমিতির সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় সমাজের চিত্তবান ও বিত্তবান মানুষের আর্থিক ও মানবিক সহায়তায়। তবে এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এগিয়ে আসে, তাহলে এমন আরও কিছু করা যাবে’।

লেখক ঁ নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট