চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মানব-সভ্যতা বিকাশে পানি প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম

মহসীন কাজী

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৫৪ পূর্বাহ্ণ

পানির আরেক নাম জীবনÑ চিরন্তন সত্য এ কথা। এ পর্যন্ত যত গ্রহ-উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটিমাত্র গ্রহেই পানির অস্তিত্ব রয়েছে। তার নাম পৃথিবী। পৃথিবীকে বলা হয় ‘জলের গ্রহ’ বা ‘প্ল্যানেট অব ওয়াটার’। অন্য কোনো গ্রহ-উপগ্রহে আজ পর্যন্ত পানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাই সেখানে জীবনও নেই। জীবনের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে পানি।
পৃথিবীর তিনভাগ জল, মাত্র একভাগ স্থল। উদ্ভিদ-প্রাণী নয়, তাদের প্রধান ধারণস্থল পৃথিবীর স্থলভাগও সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে। পৃথিবীটাই এক সময় জলময় ছিল। পৃথিবীর নিজ অক্ষদ-কেন্দ্রিক এবং সূর্যকেন্দ্রিক- দুই ঘূর্ণনের ফলে দুগ্ধমন্থনে মাখন ওঠার মতো কালক্রমে বেরিয়ে এসেছে এ গ্রহের স্থলভাগ।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শারীরিক ওজনের ৬০ শতাংশ এবং নারীর ৫৫ শতাংশই পানি। সাধারণভাবে, একটি শিশুর শরীরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের গড়পরতা ৪৫ শতাংশ পানি দিয়ে গঠিত।
আমাদের সভ্যতার সূচনাও পানিকে ঘিরে। প্রাচীন সব সভ্যতার উৎস হচ্ছে কোনো না কোনো নদী। অর্থাৎ জলধারা কেন্দ্রিক। সিন্ধু সভ্যতার গোড়াপত্তন সিন্ধুনদ থেকে। দজলা-ফোরাত (টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস) থেকে এসেছে মেসোপটেমীয় সভ্যতা। অনুরূপভাবে মিশরীয় সভ্যতায় আছে নীল নদ, রোমান সভ্যতায় তিবের, চিনা সভ্যতায় ইয়াং সিকিয়াং আর হোয়াংহো। হাজার হাজার বছর আগেকার সিন্ধুতীরের হরপ্পা-মহেনজোদারো, গঙ্গাতীরের কাশী-বারাণসী, তিবের নদীর তীরের রোম নগরী থেকে শুরু করে আজকের টেমস তীরের লন্ডন, সঁ নদীর তীরের পারি, ভল্গাতীরের মস্কো, যমুনা তীরের দিল্লি, ভাগিরথী তীরের কোলকাতা, বুড়িগঙ্গা তীরের ঢাকা, কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম নগর।
একসময় পণ্যের পরিবহন ও বিপণনে, সামরিক অভিযানে, সভ্যতার ক্রমপ্রসারেও নদী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। জলপথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দুনিয়ার তাবৎ বন্দর। প্রাচীনকাল থেকে এই বন্দরগুলোই এক দেশের সাথে আরেক দেশের সংযোগ ঘটিয়ে চলেছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগ এখনও পরিচালিত হয় জলপথে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের নব্বইভাগই জলপথ তথা বন্দর-নির্ভর। সভ্যতার ইতিহাসও তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে।
পানীয় জল বা খাওয়ার পানি বলতে আমরা বুঝি, যে-পানি পান করা এবং খাদ্য প্রস্তুতির জন্যে নিরাপদ। নির্দিষ্ট বায়ুচাপ, পুষ্টি এবং সৌরশক্তির পাশাপাশি তরল পানিও বেঁচে থাকার জন্যে অত্যাবশ্যক। কিন্তু সে-পানি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ না হলে তা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণ্যে সরবরাহকৃত কলের পানি বিশুদ্ধ পানীয় জলের মানসম্মত। অথচ তারপরও সেসব দেশে খাওয়া বা রান্নার কাজে এ পানি খুব কমই ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ধোয়া, গোসল, শৌচকর্ম এবং সেচকাজেই এ পানি বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব দেশে গ্রে-ওয়াটার বা ঘোলাপানিও সরবরাহ করা হয়, যার ব্যবহার দেখা যায় শুধু শৌচকর্ম ও সেচকাজে। বিষাক্ততার মাত্রা বা মিশে থাকা কঠিন পদার্থের পরিমাণের কারণেও পানি গ্রহণের অনুপযোগী হতে পারে।
পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের মোটামুটি ৯০ শতাংশ মানুষ পানের উপযোগী বিশুদ্ধ পানির উৎস পায়, যাকে বলা হয় উন্নত পানির উৎস (রসঢ়ৎড়াবফ ধিঃবৎ ংড়ঁৎপব)। আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলে পানযোগ্য পানি পায় সেখানকার মোট জনসংখ্যার চল্লিশ থেকে আশি শতাংশ। সারা বিশ্বে কলের পানি পায় ৪২০ কোটি লোক। আরো ২৪০ কোটি পায় কুয়ো বা পাবলিক কল ব্যবহারের সুবিধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) মনে করে, নিরাপদ খাবার পানি পাওয়াটা মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ তারপরও বিশ্বের একশ থেকে দুইশ কোটি লোক আজও এ অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধু দূষিতপানি পানের কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে সপ্তাহে তিরিশ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। ২০১০ সালে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন বলেছিলেন, যুদ্ধে যত-না মানুষ মরে, তার চেয়েও বেশি মরে অনিরাপদ পানি খেয়ে।
হু’র প্রতিবেদন ২০১৭ অনুযায়ী নিরাপদ পানীয় জল হলো সেই পানি যা জীবনভর পানে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই বা জীবনের কোনো পর্যায়ে কোনোরকমের সংবেদনশীলতার সৃষ্টি করে না। “নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় পানীয় জল সরবরাহ” (ংধভবষু সধহধমবফ ফৎরহশরহম ধিঃবৎ ংবৎারপব) বলতে বোঝায় ‘নিজের ঘরে বা প্রাঙ্গণে প্রয়োজনমতো এবং দূষণমুক্ত পানির ব্যবস্থা’। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭১ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি মানুষ কম-বেশি এ সেবা পায়।
জাতিসংঘের সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর একটা হলো পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সম্পর্কিত (গউএ ৭, ঞধৎমবঃ ৭প)। এটাতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো ‘২০১৫’র মধ্যে নিরাপদ পানি ও মৌলিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সুযোগহীন মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার।’ লক্ষ্যটা বাস্তবায়নের ভার দেয়া হয় হু ও ইউনিসেফের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কিত যৌথ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি জেএমপিকে।

পানির উন্নত উৎসের এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর আগে ২০১০ সালেই পূর্ণ হয়ে যায়। ১৯৯০-এ যতজন পেতো, ২০১০-এ এসে তার চেয়ে আরো অন্তত ২০০ কোটি বেশি লোক উন্নত পানীয় জল পেতে শুরু করে। কিন্তু কাজ তখনও শেষ হয়নি। বিশ্বের প্রায় ৭৮ কোটি মানুষ আজও পানীয় জলের অনুন্নত উৎস ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও আরো অনেক লোক খাওয়ার জন্যে নিরাপদ পানি পায় না। তা ছাড়া হিসেব করে দেখা গছে যে, ‘উন্নত’ বলে পরিচিত উৎসগুলোর মধ্যেও অন্তত ২৫ শতাংশে মলমূত্রাদির দূষণ আছে। সারা পৃথিবীতে অন্ত ১৮০ কোটি লোক এমন সব উৎস থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে, যেগুলো দূষণাক্রান্ত। এসব উৎসের পানির মান সময় বা ঋতুভেদে বদলায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে এসব উৎসের পানি আরো খারাপ হয়ে যায়।

এ অবস্থায় সকলের জন্যে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে গেলে শহর ও গ্রামের মধ্যেকার বৈষম্য ও অসমতা এবং দারিদ্র্য দূর করতে হবে; আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চল এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহের নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটাতে হবে; বিশ্বব্যাপী পানীয় জলের মান পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে হবে; এবং সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী নিরাপদ পানি সংস্থানের ক্ষেত্রে এমডিজি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে আরো সামনে তাকাতে হবে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং, ঝউএ)’র একটি হলো ‘ওয়াশ’ বা ডঅঝঐ (ডধঃবৎ, ঝধহরঃধঃরড়হ, ঐুমরবহব) কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হলো সকলের জন্যে নিরাপদ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, এবং বাসস্থল নয় এমন সব প্রতিষ্ঠান, যেমন বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, কর্মস্থল প্রভৃতিতে এসবের ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও অবধারণ করা।
বেশকিছু আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশগুলোতে নিরাপদ পানীয় জলের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো ওয়াটারএইড ইন্টান্যাশনাল (ডধঃবৎঅরফ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ)। নেপাল, ভারত, তানজানিয়া, ঘানাসহ মোট ২৬টি দেশে সংস্থাটি দীর্ঘমেয়াদি ও নির্ভরযোগ্যভাবে বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সেসব দেশের মানুষের জীবনমান স্থায়ীভাবে উন্নত করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নিরাপদ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে জনসাধরণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যেও কাজ করে যাচ্ছে ওয়াটারএইড।
উপমহাদেশে পানির এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উৎকৃষ্টতম ব্যবহারের ধারা বজায় রয়ে সিন্ধুসভ্যতা পরবর্তী যুগগুলোতেও। বড় বড় নদীগুলোকে আর সমুদ্রকে দেবতার আসনে বসানোর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, প্রাচীনকালে আমাদের দেশের মানুষ জলকে কত গুরুত্ব দিতো। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো উপমহাদেশেও সিন্ধুসভ্যতার আমল থেকে সব শহর গড়ে উঠেছে বড় বড় নদীর বা সমুদ্রের তীরে, কখনো-বা উভয়ের সঙ্গমস্থলে। গ্রাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও নদী বা হ্রদ বা কোনো বড় জলাশয়ের তীরকে প্রাধান্য দেয়া হতো। নদী থাকুক আর না-ই থাকুক, ব্যক্তিগত বা বারোয়ারি ব্যবহারের জন্যে কুয়ো, দিঘি এবং পুকুরও খনন করা হতো বিস্তর। ‘পুকুর’ কথাটা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘পুষ্করিণী’ থেকে, যার উদ্ভব পুরাণোক্ত যক্ষ ‘পুষ্কর’-এর নাম থেকে। মূলত পুকুরের নিরাপত্তা ও শুচিতা রক্ষার প্রয়াসেই বলা হতো, এ জলাধার পুষ্কর নামের যক্ষ রক্ষা করেন। এর জলে অনাচার করলে পুষ্কর তাকে শাস্তি দেবেন। জলের অতলে যক্ষপুরীতে নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলবেন। পুষ্কর দ্বারা রক্ষিত বলেই এ জলাধারের নাম পুষ্করিণী। অবশ্য, পুষ্করের সঞ্চরণ শুধু পুকুরেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। কুয়ো, দিঘি বা অন্য জলাধারের জলও যক্ষরা রক্ষা করেন, এমনটাই ছিলো লোকবিশ্বাস। এমনকি এখনও এদেশের লোক পুরনো পুকুর-দিঘির জলে ‘যখ’ থাকার কথা বলে। দিঘি ও পুকুর প্রতিষ্ঠা একটা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত হতো। রাজা-সম্রাট, সুলতান-নবাব-বাদশা থেকে শুরু করে গ্রামের জমিদার বা সাধারণ গৃহস্থ সাধ্যমতো দিঘি-পুকুর প্রতিষ্ঠা করতো। খাওয়া, রান্না ও ধর্মীয় কাজে যে-পুকুরের জল ব্যবহার করা হতো, তা সবধরনের দূষণ থেকে অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে রক্ষা করাটা ছিলো বাধ্যতামূলক। হিন্দুদের কাছে জল তো চিরকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলোই, পরবর্তীতে শাসক মুসলিমদের কাছেও পানির গুরুত্ব কম কিছু ছিলো না। ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়াও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও পানি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলো। দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ার আগে ওজু করার জন্যে তথা পাকসাফ হওয়ার জন্যে পানি না হলে তাদের চলতো না। ফলে প্রতিটি মন্দির-মসজিদ-কিয়াং ইত্যাকার অপরিহার্য অঙ্গ ছিলো পরিচ্ছন্ন একটি পুকুর বা অন্য কোনো জলাধার।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের অবস্থান কর্ণফুলী নদীর তীরে। বঙ্গোপসাগরের সাথে নদীটির সঙ্গমস্থলে গড়ে তোলা হয়েছে এই শহর। ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড় ও টিলা আর অরণ্যে ভরপুর এ শহরে তখন বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক পানির উৎস হিসেবে ছিলো প্রচুর পাহাড়ি ঝরনা বা ছরা। চট্টগ্রাম শহরের যেসব জায়গার নাম বা পরিচিতির সঙ্গে ঝরনা শব্দটি জড়িত আছেÑ যেমন মাছুয়া ঝরনা, ঘাটফরহাদবেগের ঝরনা, জামালখানের জোড়াঝরনা, হাজারি গলি আর পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডের ঝরনা। সেসব জায়গায় ঝরনার বাস্তব অস্তিত্ব কয়েক দশক আগেও ছিল। মোগল আমল বা তার আগে থেকেই এসব প্রাকৃতিক পানির উৎসের মুখ বাঁধিয়ে কুয়োর মতো করে দেয়া হয়েছিলো, যাতে এগুলো ব্যবহার করতে জনসাধারণের সুবিধা হয়। সেসব ঝরনার প্রায় সবগুলোই এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত কিংবা পরিত্যক্ত।
ব্যবহার্য পানির উৎস হিসেবে চট্টগ্রাম শহরে পুকুর এবং দিঘিও ছিলো অসংখ্য। এত বেশি যে, চট্টগ্রামকে অনায়াসে ‘পুকুরের শহর’ বলা যেতো। সেসব পুকুরের ৯৫ শতাংশেরও বেশি বুজিয়ে ভবনাদি নির্মাণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত দিঘিগুলোর কয়েকটার নাম লালদিঘি, আসকারদিঘি, বলুয়ার দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি, কমলদহ প্রভৃতি। কিছু দিঘি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। কিছু দিঘি আজও টিকে আছে অত্যন্ত করুণ অবস্থায়। এসবের পানি পঙ্কিল ও দূষিত।
জানা যায়, সৈন্যদের জন্যে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে মোগল শাসক নবাব আসকার খান ১৬৬৯ থেকে ১৬৭১ সালের মধ্যে প্রায় চার একর আয়তনের আসকার দিঘিটি খনন করেন। পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ টলটলে জলভর্তি দিঘিটির চোখ জুড়োনো রূপ কয়েক দশক আগেও দেখতে পাওয়া যেতো। এখন দিঘির কিনারার দিকের পানির অংশ ভরিয়ে বা তার ওপর কাঠের মাচা বানিয়ে তোলা অসংখ্য আসবাবপত্রের দোকান আর বাসভবনের চাপে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ। আগাগোড়া কচুরিপানায় ঢাকা দূষিত দুর্গন্ধযুক্ত কালচে পানিতে ভর্তি এ প্রাচীন জলাশয়কে দেখে তার আগের চেহারা কল্পনাই করা যাবে না! একই অবস্থা নগরীর কোরবানিগঞ্জে অভয়মিত্র মহাশ্মশানের পাশে অবস্থিত বলুয়ার দিঘিরও। অন্যদিকে কমলদহ প্রভৃতি কিছু দিঘির আজ চিহ্নও নেই। ফিরিঙ্গি বাজারের বহুপ্রাচীন দামুয়া পুকুর এবং আরো অসংখ্য পুকুরেরও আজ অস্তিত্ব নেই।
ব্রিটিশ আমলের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়। এটিকে কেন্দ্র করে এখানে রেল কর্মচারীদের বিশাল বসতি গড়ে উঠে। এখানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১৯২৪ সালে লেকে বাঁধ দিয়ে একটি পাহাড়ি ছরা বা ঝরনার প্রবাহ রোধ করে বানানো হয় একটি কৃত্রিম হ্রদ। প্রকল্পটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার মি. ফয়্-এর নামানুসারে এটার নাম রাখা হয় ফয়্’স লেক। এ লেকের পানি এখন আর ব্যবহৃত হয় না। বর্তমানে এটাকে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দাদের ব্যবহার্য পানির সংস্থানে অতীতে এরকম নানা উদ্যোগের মাধ্যমে উৎসের সৃষ্টি করা হয়। তবে সাধারণ নগরবাসী পানির জন্যে নির্ভর করতো মূলত প্রাকৃতিক ঝরনা এবং নিজেদের বা পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে খনিত কুয়ো, পুকুর ইত্যাদির ওপর। ১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভা (মিউনিসিপ্যালিটি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নগরবাসীর জন্যে খাওয়ার পানি সরবরাহের দায়িত্বটা তার ওপর গিয়ে পড়ে। কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির কলের জল তখনও এ শহরের খুব কম মানুষই পেতো। এর ঠিক একশ বছর বছর পর ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ বা চট্টগ্রাম ওয়াসা (ঈযরঃঃধমড়হম ডধঃবৎ ধহফ ঝববিৎধমব অঁঃযড়ঃরঃু-ঈডঅঝঅ)। তখন থেকে ওয়াসাই নগরবাসীকে পানি সরবরাহের দায়িত্বটা পালন করে আসছে। আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও চট্টগ্রাম পৌরসভা থেকে পাওয়া মাত্র ২৫টি গভীর নলকূপের সাহায্যে প্রতিদিন দুই কোটি লিটার পানি তুলে সরবরাহ করার মধ্যে দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। বর্তমানে তা বেড়ে ৩৬ কোটি লিটারে দাঁড়িয়েছে। অচিরে ওয়াসার আরো দুটো প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, যার ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ সংস্থার পানি উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
৫৭ বছরে পরিশোধিত পানি উৎপাদন ১৮ গুণ বেড়েছে বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেড়েছে তার চেয়ে আরো অনেক গুণ বেশি। কাজেই, ওয়াসার পানি পায় না এমন লোকের সংখ্যা চট্টগ্রাম মহানগরীতে এখনও বিস্তর। পানি উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি। পানি উৎপাদন বাড়ানোর হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি না করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন বাদে ওয়াসার পানির প্রধান উৎস হলো নগরীর দু’পাশ দিয়ে প্রবহমান দুটি নদী কর্ণফুলী ও হালদা। ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস হিসেবে এ দুটি নদী থেকে ওয়াসা প্রতিদিন ৩২ কোটি লিটার পানি তুলে সরবরাহ করে। এর মধ্যে হালদা থেকে ১৮ কোটি এবং কর্ণফুলী থেকে ১৪ কোটি লিটার পানি তোলা হয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কর্ণফুলী থেকে আরো ২০ কোটি এবং হালদা থেকে আরো ৯ কোটি লিটার পানি তুলে সরবরাহ করার জন্যে এখন কাজ চলছে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে পানি চিরকাল লেগেছে, লাগছে এবং লাগবে। পরিশোধিত পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত ওয়াসা’র মতো সেবা সংস্থার দায়িত্ব কখনও কমবে না বা ফুরোবে না। বরং দিন দিন নগরীর মানুষ এবং আয়তন যত বাড়ছে, ওয়াসার কাজের বা সেবার পরিধিও ততই বাড়ছে। লক্ষ লক্ষ নগরবাসীকে পানি যোগানোর লক্ষ্যে ওয়াসা ভূ-গর্ভ ও ভূ-উপরিতল- দুদিক থেকেই প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি সংগ্রহে বাধ্য হচ্ছে। ওয়াসার নেয়া নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই সংগ্রহের পরিমাণ আরো বাড়বে।
কর্ণফুলী আর হালদা নদীর গুরুত্ব বহুমুখী। দেশের অর্থনীতিতে কর্ণফুলীর অবদান কারও অজানা নয়। জোয়ার-ভাটার এই নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর। এতদ্ঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে শত শত বছর ধরে এই বন্দরের নাম জড়িয়ে আছে। তাই কর্ণফুলীকে বলা হয় বাংলাদেশের লাইফলাইন। কৃষি অর্থনীতিতে হালদার ভূমিকা অপরিসীম। এটি হচ্ছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজণন ক্ষেত্র। প্রতিবছর এ নদীতে কার্পজাতীয় (রুই, কাতাল ও মৃগেল) মাছ ডিম ছাড়ে। দেশের ৮০০ নদ নদীর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম এ নদী। বিশ্বের ব্যতিক্রম নদীর মধ্যে হালদা স্থান করে নিয়েছে অনেক আগেই।
শুধু কী তাই। চট্টগ্রামবাসীর চাহিদার নব্বইভাগ পানি সরবরাহের মূল উৎসও হচ্ছে কর্ণফুলী আর হালদা নদী। দু’নদীকে ঘিরে চট্টগ্রাম ওয়াসা আরও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। নতুন কোনো উৎস সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামে সুপেয় এবং ব্যবহার্য পানির উৎস হচ্ছে এ নদী। কলকারখানার অপরিশোধিত দূষিত-বর্জ্য, পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল, স্লুইস গেট দিয়ে প্রবাহে বাধা সৃষ্টি এবং বিষ প্রয়োগের কারণে কর্ণফুলী ও হালদার পানি দূষিত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে নদী দুটিতে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। অর্থনীতি আর পানির প্রবাহ অক্ষুণœ রাখতে কর্ণফুলী ও হালদা রক্ষা আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি সকল সংস্থার পাশাপাশি এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসারও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
লেখক : বোর্ড সদস্য, চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালনা পর্ষদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট