চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

একান্ত সাক্ষাৎকারে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ

দৈনিক ৩৬ কোটি লিটার সুপেয় পানি দেয় ওয়াসা

সারোয়ার আহমদ

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে নিরাপদ সরবরাহের সরকারি একমাত্র সেবাসংস্থা চট্টগ্রাম ওয়াসা। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেবাসংস্থাটি নগরীতে পানি সরবরাহ দিয়ে আসছে। এ নিয়ে ওয়াসার ওপর নগরবাসীর সন্তোষ্টির পাশাপাশি রয়েছে অভিযোগও। এ নিয়ে দৈনিক পূর্বকোণের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে আদ্যপান্ত তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘নিরাপদ পানি বলতে বুঝি যে সুপেয় পানি পান করলে মানুষ অসুস্থ হবে না। সেটাই হলো নিরাপদ পানি। ওয়াসার দায়িত্ব হলো পানিকে সুপেয় ও নিরাপদ করা। নিরাপদ করতে সাধারণত দুইভাবে পানি সংগ্রহ করি। নদী থেকে যে পানি সংগ্রহ করা হয় তাকে সারফেস ওয়াটার বা ভূ-উপরিস্থ পানি বলা হয়। আরেকটি হলো ভূ-গর্ভস্থ পানি। যা টিউবওয়েল এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এই দুই মাধ্যম থেকে পানি নিয়ে নিরাপদ করে সরবরাহ করে ওয়াসা। টিউবওয়েলের পানি প্রায় সব সময়ই নিরাপদ হয়। তারপরও অধিক নিরাপত্তার জন্য টিউবওয়েলের পানির সাথে সামান্য পরিমাণ ক্লোরিন যুক্ত করা হয়। যেন কোন জীবাণু থাকলেও সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। আর ভূ-উপরিস্থ নদীর পানি অর্থাৎ সারফেস ওয়াটার সংগ্রহ করে কয়েক ধাপে ট্রিটমেন্ট করা হয়। কয়েক ধাপে পানিকে ট্রিটমেন্ট করে নিরাপদ করার পর পাইপলাইনে সরবরাহের আগে সামান্য ক্লোরিন মেশানো হয়। অর্থাৎ নিরাপদ করার পরও ক্লোরিন মেশানোর কারণ হলো যদি কোন কারণে কোন জীবাণু পানিতে চলে আসে তা যেন ধ্বংস হয়ে যায়। সেজন্যই ক্লোরিন মেশানো হয়। এই ক্লোরিন মিশিয়ে পানির ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার প্রক্রিয়াটি বিশ্বে একটি গ্রহণযোগ্য ও সর্বব্যবহৃত পন্থা। আরেকটি উপায় আছে যা হলো ওজন নিয়ে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা যা অনেক ব্যয় বহুল প্রক্রিয়া। চট্টগ্রামে ভূ-উপরিস্থ পানি সংগ্রহ করতে হলে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর ওপরই ভরসা করতে হয়। এই দুটি ছাড়া চট্টগ্রামে আর কোন মিঠা পানির নদী নেই। আর এখানে কোন লেকের পানিও নেই। তাই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে নানা ধাপে ট্রিটমেন্ট করে এবং শেষ ধাপে ক্লোরিন মিশিয়ে পানিকে নিরাপদ করে পাইপলাইনে সরবরাহ করি। সরবরাহের আগে তিনটি ল্যাবরেটরিতে সেই পানি পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় যে, পানিতে কোন জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া নেই। এটাই হলো চট্টগ্রাম ওয়াসার সুপেয় পানি সরবরাহ করার মূল পদ্ধতি। তবে পানিকে আরো সুপেয় করা যায় পানিতে মিনারেল মিশিয়ে। কিন্তু তাতে পানির খরচ বেড়ে যাবে। যা সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় বহুল হবে।’

প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই চট্টগ্রাম ওয়াসার মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ করে। শুধু পানির উৎস একেক জায়গায় একেক রকম। বিভিন্ন দেশে নদী আছে আবার কোথাও লেক আছে। যেমন আফ্রিকাতে ভিক্টোরিয়া লেক থেকে পানি নেয়া হয়। তারপর নানা পক্রিয়ায় পানি নিরাপদ করে সরবরাহ করা হয়। যাদের নদী আছে তারা সেখান থেকে নিয়ে একই নিয়মে নিরাপদ পানি সরবরাহ করে। কিছু কিছু দেশ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে পানি উত্তোলন করে সরবরাহ করে। যেমন ফিলিপাইনের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারে অবস্থা ভাল। দেশটি ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে সরবরাহ করে। আবার ইউরোপ-আমেরিকার মতো কিছু কিছু দেশে টিউবওয়েল স্থাপন করা নিষিদ্ধ। তারা নদী বা লেকের উপর নির্ভরশীল।
চট্টগ্রাম ওয়াসার আগে পানি সরবরাহের সক্ষমতা ছিল ৩০শতাংশ। এখন তা বেড়ে হলো ৯৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম ওয়াসা এখন শহরের ৯৫ ভাগ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে পারছে। তারপরও ওয়াসা এখনো সন্তুষ্ট নয়। নগরবাসী ২৪ ঘণ্টা প্রেসারে পানি পেলে সন্তুষ্ট হবে। অর্থাৎ মানুষ বাসার টেপ খুললেই যেন পানি পায়। পানি ট্যাংকে রাখতে যেন না হয়। ওই প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার জন্যই ওয়াসা কাজ করে যাচ্ছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত ওয়াসা সময় নিলেও ২০২১ সালের মধ্যে সে কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশাবাদী। বর্তমানে সবাই ওয়াসার লাইন নিলে আমাদের চাহিদা হবে দৈনিক ৪২ কোটি লিটার। কিন্তু যেহেতু সবাই লাইন নেয়নি, তাই ৩৬ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছি।

চট্টগ্রাম ওয়াসা আরেকটি চিন্তা ছিল যারা সামর্থ্যবান তারা ওয়াসার পানি কিনে ব্যবহার করবে। কিন্তু নি¤œবিত্ত মানুষ পানি কিনে ব্যবহার করতে পারবে না। এমন অসামর্থ্যবান মানুষরা কি করবে ? সেজন্য ওয়াসা ১৯৮০-৮৬ সালের মধ্যে শহরের বিভিন্ন নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য টিউবওয়েল বসানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। তখন প্রায় সাড়ে ৭শ’ টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। যেখানে গরিব লোকের বসবাস ছিল সেখানে ওইসব টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। তবে সেগুলোতে কিছু অপব্যবহারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন এলাকার কিছু প্রভাবশালী মানুষ ও দোকানদার সে সব টিউবওয়েলে পাইপ লাগিয়ে মোটর নিয়ে পানি উত্তোলন করে বিক্রি করতে দেখা গেছে।

সে কারণে অনৈতিক কর্মকা- চলায় কয়েকটি টিউবওয়েল বন্ধ করে দিয়েছে ওয়াসা।
তবে বর্তমানে ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে ওয়াসা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। কোথাও কোন বস্তি একটু উন্নত হলে সেখানে একটি গ্রুপ তৈরি করে একজন প্রতিনিধি সৃষ্টি করে দিচ্ছি। সেখানে টাকার বিনিময়ে একটি মিটার দিয়ে ওয়াসার পানি সরবরাহ দিচ্ছে। ওই প্রতিনিধি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মিটার অনুযায়ী ওয়াসাকে বিল পরিশোধ করছে। এভাবে শহরের বিভিন্ন বস্তিতে প্রায় অর্ধশত লাইনে পানি সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার কল রয়েছে প্রায় ৭শ’।’

প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি জীবানুমুক্ত কিনা তা দেখতে সপ্তাহে শহরের ৬০টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে ওয়াসা। মাসে প্রায় ২৪০ থেকে ২৫০টি নমুনা পানি সংগ্রহ করে ওয়াসার ল্যাবে টেস্ট করা হয়। সর্বক্ষেত্রেই দেখা যায় ওয়াসার পানি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু যখনই বিভিন্ন বাসা বাড়ির ট্যাংক থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে, তখনই তাতে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কারণ, তারা নিয়মিত ট্যাংক পরিষ্কার করে না। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাংক পরিষ্কার করে না। অনেক জায়গায় এমনও আছে টয়লেট ও পানির ট্যাংক পাশাপাশি। যে কারণে সেসব এলাকায় পানিবাহিত রোগ দেখা যায় বেশি।’

প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘খাবার পানির বিষয়ে ওয়াসার একটি প্রকল্প চলমান আছে। যা এক বছরের মধ্যে শেষ হবে। ওয়াসার এই বোটল্যান্ড প্লান্ট থেকে খাবার পানি তৈরি করতে খরচ হবে ৮ টাকার মত। তখন ওয়াসা এই খাবার পানি বাজারে ছাড়লে অন্যসব বেসরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেশি দামে পানি বিক্রি করতে পারবে না। মূলত খাবার পানির দাম সহনশীল রাখতেই এই প্রকল্পের কাজ চলছে যা আগামী এক বছরের মধ্যে শেষ হবে।
ওয়াসার পানিতে পানিবাহিত রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘নগরীর হালিশহর ও শেরশাহ এলাকা ছাড়া আর কোথাও গত ৮/১০ বছরে পানিবাহিত রোগের তথ্য পাওয়া যায়নি। শেরশাহতে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় পানিতে জীবাণু পাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। ওয়াসা থেকেও পানি টেস্ট করে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরে তিনদিন ধরে পানি বন্ধ রেখে পাইপলাইনে ব্লিচিং পাউডার ও ক্লোরিন দিয়ে পরিষ্কার করে নিরাপদ করার পর আবার পানি সরবরাহ শুরু করা হয়। এছাড়া হালিশহর এলাকায় ট্যাংকের পানিতেই জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। জোয়ারের পানির কারণে সেখানে পানির ট্যাংকে জীবাণু ঢুকে পরে। তাতে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেখানে ওয়াসার পানির সমস্যা ছিল না। আবার এমনও তথ্য ছিল যে হালিশহরের এমন জায়গায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়েছে যেখানে ওয়াসার লাইনও নেই।

স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় নগরীতে পানি সরবরাহে সমস্যার প্রসঙ্গে প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রামে আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত কোন স্যুয়ারেজ প্ল্যন তৈরি হয়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। ঢাকায় অল্প কিছু আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে তাও নেই। উচিত ছিল এখানে অনেক আগে থেকে এই স্যুয়ারেজের কাজ শুরু করা। ওয়াসা এখন সেটির ওপর একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে এবং সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করছে। মাস্টার প্ল্যানে চট্টগ্রাম শহরকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেই ছয় ভাগের একভাগ ডিপিপি করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী সেটি অনুমোদন করে দিয়েছেন। তিনি তিন হাজার ৮০৮ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন করে দিয়েছেন। সাধারণত এসব টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই প্রকল্প ঋণ ছাড়াই ব্যয়ের জন্য অনুমোদন নিয়ে দিয়েছেন। তিনি সবসময়ই চট্টগ্রামের ব্যাপারে আন্তরিক। এখন ওয়াসার নিযুক্ত কনসালটেন্ট ডিজাইন ড্রইং এর কাজ করছে। তারা সেটি ওয়াসাকে দিলে ৫/৬ মাসের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করে কাজ শুরু করে দিতে পারবো। সরকারি খরচে একটি জোনের কাজ শেষ হবে। আর অবশিষ্ট পাঁচটি জোনের জন্য ডেভেলাপমেন্ট পার্টনার নেওয়ার চেষ্টা করছি। সেটি পেলে ওইসব জোনের কাজও শেষ করতে পারবো।
তিনি আরো বলেন,চট্টগামবাসীকে বলবো ২০২১ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের সব মানুষ শতভাগ নিরাপদ পানি পাবে। তারা বাসার টেপ খুললেই প্রেসারে পানি পাবে। নগরবাসীর কাছে আরেকটি অনুরোধ করবো। কেউ যেন পানি অপব্যবহার না করে। এই পানি অনেক দামী। অনেক কষ্ট করে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই পানি সরবরাহ করা হয়। তাই পানির যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। কোন সমস্যা হলে তারা যেন আমাদের জানায়। এটি আগের ওয়াসা নেই। বর্তমান ওয়াসা হলো জনগণের।
* নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট