চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বৃষ্টির পানি-সংরক্ষণ সংকট মোকাবেলা সম্ভব

ড. মো.মনজুরুল কিবরীয়া

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪২ পূর্বাহ্ণ

জীবন-ধারণের এক মৌলিক উপাদান হচ্ছে পানি। এটি পরিবেশ সুরক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পানির ব্যবহারের ওপর মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। একদিকে পৃথিবী থেকে মিষ্টি পানির উৎস কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে পানির অপচয় রোধ করা না গেলে আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কথায় আছে পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ জল এবং অবশিষ্ট অংশ স্থল। তবুও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুষ্ঠুভাবে বাঁচাতে এবং জীবজগতকে সুস্থ পরিবেশে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ পানির জন্য ভাবতে হচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে পৃথিবী পানি সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও সিংহভাগ পানের বা চাষের অযোগ্য। মিষ্টি পানির মোট পরিমাণ খুবই সামান্য, তাও সহজলভ্য নয়। পৃথিবীর মোট পানির মধ্যে ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ লবণাক্ত এবং মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবহার যোগ্য। এর মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ বরফে ঢাকা ও তুষার শৃঙ্গে আটকে রয়েছে। মাত্র ০ দশমিক ৩ শতাংশ পাওয়া যায় নদ-নদী, জলাশয়, পুকুর, ঝিলে এবং এক ভাগ পানি মাটির নিচে আটকে আছে।
চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। জনসংখ্যা অনুপাতে শহরে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ৪২ কোটি লিটার। কিন্তু ওয়াসা সরবরাহ করে ৩৬ কোটি লিটার। প্রধানত ভূ-পৃষ্ট ও ভূ-গর্ভস্থ এ দুটি উৎস থেকে পানি সরবরাহ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর মধ্যে ৩২ কোটি লিটার ভূ-পৃষ্ঠের উৎস হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে। অবশিষ্ট ৪ কোটি লিটার ভূ-গর্ভ থেকে সরবরাহ হয়। তবে এখনো ৬ কোটি লিটার পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণ করা হবে চট্টগ্রাম ওয়াসার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাকৃতিক পানির উৎস কমে যাওয়া, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর অন্যতম কারণ।
প্রাকৃতিক পানির উৎস কমে যাওয়া : পশ্চিমে পাহাড়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে দূষণ প্রবণ কর্ণফুলী নদী এবং উত্তরে একমাত্র মিঠা পানির উৎস হালদা নদী বেষ্টিত চট্টগ্রাম শহর। কর্ণফুলী নদীর পানি ভয়াবহ দূষণ, কাপ্তাই ড্যামের মাধ্যমে পানির স্্েরাতধারা ও পরিমাণ উভয়ই কমেছে। হালদা নদীর উজানে একাধিক রাবার ড্যাম নির্মাণ এবং ১৮টি শাখা খালের মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানির উৎসগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে খন্দকিয়া, কৃষ্ণখালি এবং কাটাখালি খালের মাধ্যমে শহর, উজানের চারটি পৌরসভা ও পোল্ট্রি ফার্মের বর্জ্য, কৃষি জমিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং কীটনাশকের ব্যবহারসহ বিভিন্ন কলকারখানার দূষণে হালদার পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে।
ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া : নগরীর বিভিন্ন বাড়িতে অবৈধভাবে গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিদিন ভূ-গর্ভস্থ প্রচুর পরিমাণে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। অন্যদিকে গৃহনির্মাণে বাড়ির চারিদিকে সলিড অবকাঠামো নির্মাণের কারণে এবং পর্যাপ্ত উম্মুক্ত খালি জায়গা না রাখায় ভূ-গর্ভস্থ পানির রিচার্জ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী চার দশকের মধ্যে দেশের ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে হ্রাস পাবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে আসলেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : চট্টগ্রাম সামুদ্রিক উপকূলের শহর হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভবিষ্যতে অনাবৃষ্টি, খরা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পানির ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের পর্যাপ্ত ও নিরাপদ পানির আসন্ন সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের অবশিষ্ট ৬ কোটি লিটার পানির চাহিদা (মোট চাহিদার ১৪ শতাংশ) পূরণ করা সম্ভব। একইসাথে জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকেও পরিত্রাণ পাবে নগরী।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরের স্বচ্ছল একটি পরিবারে সরবরাহ করা পানির ৪১ শতাংশ ব্যয় হয় গোসলের কাজে। ২২ শতাংশ কমোড ফ্ল্যাশ ও কাপড়-চোপড় পরিষ্কারে। প্রতিবার ফ্ল্যাশে ১৫ লিটার পর্যন্ত পানি খরচ হয়। এ হিসাবে পাঁচ সদস্যের ওই পরিবারে কেবল টয়লেট ব্যবহারেই দৈনিক ৩৭৫ লিটার পানি খরচ হয়। এ হিসাব থেকে শুধুমাত্র টয়লেট ব্যবহারের পানি যদি বৃষ্টির পানি থেকে সংস্থান করা যায় তবে চট্টগ্রাম শহরের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ : বাংলাদেশে প্রায় গড়ে ২ হাজার ৪৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। দেশে বর্তমানে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে তার একটি বাস্তবসম্মত, সাশ্রয়ী ও টেকসই সমাধান হল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং। পানির সংকট মেটাতে প্রতিবেশি ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের অনেকও দেশে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের নজির রয়েছে।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটিও সহজ। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার পর তা পরিষ্কার করে ছয় থেকে নয় মাস মেয়াদে সহজেই সংরক্ষণ করা সম্ভব। যদি ছয় মাসের মধ্যে বৃষ্টি নাও হয় তাতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ বছরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তা দিয়ে বাংলাদেশের সব চাহিদার অবসান ঘটানো সম্ভব। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে আমাদের দেশে আইন রয়েছে। তার যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। শহরের গৃহনির্মাণ বিধিমালার মধ্যে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার বাধ্যবাধকতা থাকলে পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
ঝুঁকি বিবেচনায় দেখা গেছে, বৃষ্টির পানিতে অসুখ-বিসুখের ভয় কম। প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে আমাদের মানসিকতা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সরকারের সমন্বয়ের মাধ্যমে এটা সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
১৯ বছর আগে ২০০০ সালের ১০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। যাতে সরকারি ভবনগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছিল। একই সাথে ভূ-গর্ভে যেন বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে পারে সে জন্য পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্দেশনাগুলো এখনো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলোর সংরক্ষণ : পানি অফুরন্ত সম্পদ নয়, সীমিত সম্পদ। তাই পানির গুরুত্ব অনুধাবন করে পানির উৎসগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের নিরাপদ পানির সংস্থানের জন্য উৎসগুলোর সংস্কার প্রয়োজন, যেমন হালদা নদীর শাখা খালগুলোর স্লুইসগেটগুলো পুনঃসংস্কার করতে হবে। প্রায় ৪-৫শত ফুট খালের মুখে ২০-২৫ ফুটের স্লুইসগেটগুলো পুনঃসংস্কার করে পানির স্বাভাবিক ¯্রােত নিশ্চিত করতে হবে। সরাসরি হালদা নদীর উপর নির্মিত রাবার ড্যামগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। লবনাক্ততা প্রতিরোধের জন্য শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই বাঁধের টারবাইন গেটগুলো কখনো সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না।
ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে : ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসগুলোতে পুনরায় পানি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে পানি সংকট অনেকটাই কমিয়ে আনা করা সম্ভব। নদীমাতৃক পানির দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের অনেক স্থানে ভূ-গর্ভস্থ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের বড় বড় শহরেও ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, প্রথমবারের মতো সরকার রাজশাহীর তানোর উপজেলার একটি ইউনিয়নকে ওয়াটার ট্রেস বা পানি সংকটপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে। অনেক স্থানে এক যুগ আগেও যেখানে মাটির ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, সেখানে এখন ১৬০ ফুট গভীরেও মিলছে না পানি। এর পেছনে যেসব কারণ উঠে এসেছে তা হল, ৫-৬ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে পানির স্তর কম থাকা এবং গভীর নলকূপের মাধ্যমে অতিরিক্ত হারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন।
ভূ-গর্ভস্থ পানি যেহেতু অফুরন্ত নয়, তাই এর ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। ভূ-পৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৃষ্টি ও ভূ-পৃষ্ঠের অন্যান্য পানি সংরক্ষণ করে শিল্প ও সেচে ব্যবহার করা গেলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করা যায়।

লেখক ঁ প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট