চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিরাপদ পানি নিশ্চিতে কাজ করছে ওয়াসা

মাকসুদ আলম

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪২ পূর্বাহ্ণ

যে পানি স্বচ্ছ, বর্ণহীন, গন্ধহীন, যাতে কোনো ভাসমান জৈব কিংবা অজৈব পদার্থ থাকে না এবং যাতে কোনো রোগজীবাণু নেই সেই পানিই নিরাপদ পানি। বিশুদ্ধ পানি সবধরনের মানবাধিকারের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। সবার জন্য উন্নত উৎসের পানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ৯৭শতাংশের বেশি মানুষের উন্নত উৎসের পানি পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে পুরোপুুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনও সীমিত, মাত্র ৩৪দশমিক ৬শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারে। ২০০০ সালের তুলনায় ২০১২ সালে আর্সেনিকযুক্ত পানি পানকারীর হার ২৬ দশমিক ৬ থেকে কমে ১২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপরেও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। অগ্রগতি সত্ত্বেও ১ কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখনও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। এছাড়া পানিতে ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরাইড ও লৌহ-দূষণের কারণেও খাওয়ার পানির মান খারাপ থাকে। প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে দুটি অর্থাৎ বাংলাদেশের ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া-দূষিত উৎসের পানি পান করে। আবার ঘরের কল বা টিউবওয়েলের আশপাশে পরিষ্কার না থাকায় বিভিন্ন অণুজীবযুক্ত পানি-পানকারীর সংখ্যা রয়েছে ৯ কোটি ৯০লাখ। শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণও বাংলাদেশে পানির গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অঞ্চলভেদেও পানির মানে উল্লেখযোগ্য অসমতার প্রমাণ পেয়েছে ইউনিসেফ। যেমন, রংপুর বিভাগে ৭১ দশমকি ৮ শতাংশ মানুষ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ামুক্ত পানি পান করে। সেখানে সিলেটে এ হার মাত্র ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। ধনী-দরিদ ভেদেও মানসম্পন্ন পানি পাওয়ার সুযোগে তফাৎ রয়েছে। ধনীরা নিজেদের বাড়িতেই খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে। অপরদিকে সরকারি বা অন্য কোনো উৎস থেকে পানি আনতে দরিদ্র মানুষরা আলাদা করে সময় আর শ্রম দিতে বাধ্য হয়।
বলা হয় পানির অপর নাম জীবন। কারণ পানি ছাড়া জীবন বাঁচানো যায় না । কিন্তু পানি নিরাপদ না হলে জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। জীবাণুযুক্ত পানি অনেক সময় মৃত্যুরও কারণও হয়। পানি খালি চোখে দেখতে পরিষ্কার মনে হলেও সব সময় নিরাপদ হয় না। কেননা, এই পরিষ্কার পানির মধ্যে রোগ জীবাণু থাকতে পারে। জীবাণুগুলো দেখতে এতছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। এ জন্য নদী, পুকুর, ডোবা ও কুয়ার পানি পরিষ্কার দেখালেও তা নিরাপদ নয়। নলকূপের পানি সাধারণত নিরাপদ। কিন্তু বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ নলকূপের পানিতে আর্সেনিক নামক এক- ধরনের বিষ পাওয়া গেছে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
নিরাপদ পানি পাওয়া একটি বড় সমস্যা। গ্রামগুলোতে সাধারণত প্রতিদিনের কাজে যে পানি ব্যবহার করা হয় তা আসে মূলত পুকুর, নলকূপ, নদী নালা, খালবিল, ডোবা, জলাশয় থেকে। গ্রামে নিরাপদ পানির প্রধান উৎস নলকূপ। আমরা সাধারণত নলকূপের পানি ব্যবহারকে অধিক নিরাপদ মনে করি। কিন্তু আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানি নিরপদ নয়। আর্সেনিক এমন এক ধরনের বিষ যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। এটি পানির মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করে। এ কারণে মানুষের আর্সেনিকোসিস নামক রোগ হতে পারে। এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। এ ছাড়া পুকুর, নদী নালা, খালবিল, ডোবা ও জলাশয়ের জীবাণুযুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি রোগ হতে পারে। তাই দৈনন্দিন সকল কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার করা উচিত।
পানি পরিষ্কার রাখতে কলকারখানার বর্জ্য খাল ও নদীর পানিতে ফেলা যাবে না, নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার থেকে মলমূত্র, আবর্জনা পলিথিনের ব্যাগ নদীর পানিতে ফেলা যাবে না, জীবজন্তুর মৃতদেহ পানিতে ভাসতে দেখলে তা তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, নদীতে নোঙরা পানি ও আবর্জনা ফেলা যাবে না।
দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি (যেমনÑ বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল, ধৌতকরণ ও পান করা পানি) নিয়ে দেশে এখনো পুরোপুরি সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। জনসাধারণ এখনো জানে না নিরাপদ পানি কি? খাবার পানি কোথায়, কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে? বিভিন্ন সময় ফিল্ড ভিজিটের সময় দেখা যায় গ্রাহকের ভূ-গর্ভস্থ জলাধার দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হচ্ছে না। ভবনের ছাদের জলাধারও অপরিষ্কার, গ্রাহক ট্যাপের আশপাশে এলাকাও স্যাঁতস্যাঁতে। কোন কোন জলাধারে তেলাপোকা, টিকটিকি, ইঁদুরও পড়ে আছে। এতে করে গ্রাহকের পানিতে পানিবাহিত রোগ-জীবানুর সংক্রমণ হওয়া অতি সহজ।
বাংলাদেশে নিরাপদ পানির বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ওয়াসা, এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, এককথায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর অধিদপ্তরসমূহ। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ যেমন ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, ডব্লিও এইচও, দাতা সংস্থা, এনজিওসমূহ একাজ করে থাকে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের মোট চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ পানি চট্টগ্রাম ওয়াসা সরবরাহ করতে সক্ষম। এরূপ পরিস্থিতিতে পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী ভূমিকা পালন করা সকলের কর্তব্য। এ লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মকে পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী, পানি অপচয় রোধ, পানি ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে সচেতন করার উদ্দেশ্যে পানি সাশ্রয় উদ্বুদ্ধকরণ স্কুল কার্যক্রমের ব্যবস্থা নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর আওতায় নগরীর বিভিন্ন স্কুলে পানির গুরুত্ব, এর সঠিক ব্যবহার, পানি সাশ্রয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহ নিয়ে আলোচনা, তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। তাছাড়াও ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রচারণার কাজ চলমান। মোহরা ও কর্ণফুলী পানি শোধনাগারে অবস্থিত চট্টগ্রাম ওয়াসার পরীক্ষাগারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পানির সকল ধরনের গুণাগুন পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। শোধনাগারে পানির কিছু গুণাগুণ প্রতি ঘণ্টায়, কিছু ৪ ঘণ্টা অন্তর, কিছু গুণাগুণ দৈনিক এবং কিছু সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে পরীক্ষা করে সরবরাহকৃত পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া ব্যবহারকারীর প্রান্তে পানির গুণগত মান নিশ্চিতকল্পে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিমাসে ২৪০ টি পানির নমুনা সংগ্রহ করে মোহরাস্থ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ স্ট্যার্ন্ডাড অনুসারে সরবরাহকৃত পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।

লেখক ঁ প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম ওয়াসা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট