চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অপরিকল্পিত নগরায়নে বায়ুদূষণ বন্দর নগরী চট্টগ্রাম

মো. ইকবাল সরোয়ার

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়, নদী, সমুদ্র, উপকূল সংকীর্ণ সমভূমির কারণে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ নগরী। বাংলাদেশের অন্যান্য শহর অপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও অপরিকল্পিত নগরায়ন, সচেতনতা এবং যথাযত সমন্বয়ের অভাবে এই বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের মতো মহাগুরুত্বপূর্র্ণ স্থাপনা, ব্যবসা বাণিজ্যের বহুমুখিতা, বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান এর অবস্থান সবকিছু নিয়ে এই শহরের জনসংখ্যা, আবাসন, ব্যবসা ও শিল্প-স্থাপনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু বেশির ভাগ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে চট্টগ্রাম নগরের প্রায় ৬০-৬৫ লক্ষ জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নগর পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে মানুষ যখন আগুন ব্যবহার করে রান্না করতে শুরু করেছে তখন থেকেই বায়ুদূষণের সূচনা। আবার নগরায়নের ধারা বৃদ্ধির সাথে সাথেও দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে। এজন্য নগরে নানা ধরনের সামগ্রী ও সেবার প্রয়োজন যেগুলো বায়ুদূষণের জন্য মূলত দায়ী। যেমনÑ নগর এলাকায় জনঘনত্ব ও আবাসিক স্থাপনার ঘনত্ব অধিক। এখানে অনেক মানুষের রান্নার প্রয়োজন হয়। এর ফলে বায়ুধূষক গ্যাস উৎপন্ন হয় প্রচুর পরিমাণে। আবার অন্যদিকে নগর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতে যানবাহন হতে প্রচুর পারিমাণে কার্বনমনোক্সাইড, কার্বন-ডাইঅক্সাইড ও ওজোন নির্গত হচ্ছে যা বায়ুদূষণের জন্য মুখ্যভূমিকা পালন করছে। যানবাহন গুলো প্রধানত ডিজেল, পেট্রোল ও সিএনজি ব্যবহার করে। যানবাহনগুলোর ইঞ্জিনে ক্রুটি, নিয়ামত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার না করা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ফিটনেসের অভাব ইত্যাদি কারণে নগর এলাকায় দূষণের মাত্রা বেশি। মানুষের বসবাসের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে আমরা পরিবেশ বলি। শহর এলাকার সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি মানুষের বসবাসের প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করে তখন সেই পরিবেশে বসবাস করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই প্রতিকূলতা অথবা দূষণ পরিবেশকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। নগর এলাকার পরিবেশ দূষণ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত একটি বিষয়। এর মধ্যে বায়ুদূষণ অন্যতম। চট্টগ্রাম নগর এলাকায় নির্মল বায়ু এখন অকল্পনীয় একটি বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বিশ্বের প্রতি ছয়টি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ী দূষণ। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতি চারজনের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হচ্ছে বায়ু, পানি ও মাটির দূষণ জাতীয় কারণে। দূষণের কারণে বিশ্বে ২০১৫ সালে মোট ৯০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, এর মধ্যে বেশির ভাগ মারা যায় বায়ু দূষণে।
বায়ু পরিবেশের অন্যতম একটি মৌলিক উপাদান। সুস্থ ও নির্মল বায়ু ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর। কিন্তু আমাদের নগর পরিবেশে বায়ুর অবস্থা শোচনীয়। গ্রামের চেয়ে নগর এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি হওয়ার মূল কারণ: বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন আকারের যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া, শিল্প কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, ইট ভাটার কালো ধোঁয়া, টায়ার ও প্লাস্টিক পোড়ানোর ধোঁয়া। তাছাড়া শহর এলাকায় রাস্তাঘাট সংস্কার কাজে ব্যবহারকৃত বিটুমিন পোড়নো, এসি থেকে নির্গত গ্যাস, ফটোকপি মেশিন চালানো, মশার কয়েল, এরোসল, ইট ভাঙার মেশিন এবং নিরাপত্তা রক্ষার্থে পুলিশের ব্যবহ্নত টিয়ার গ্যাস ইত্যাদি নগর এলাকায় বায়ুদূষণের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী। তাছাড়া নগর এলাকার গৃহস্থ ধূলাবালি, রাস্তার ধুলাবালি ও শহর এলাকায় বায়ুদূষণের একটি অন্যতম উপাদান। মানুষ বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। এই বায়ু যদি দূষিত হয় তাহলে মানুষের বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (অছও) অনুযায়ী বায়ুতে পাঁচটি (সাসপেনডেট পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ও ওজোন) বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বায়ুর মান অনুযায়ী বায়ুকে ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। যথাÑ১. ভাল (বায়ুর মান:- ০-৫০), ২. মোটামুটি (৫১-১০০), ৩. সতর্ক অবস্থা (১০১-১৫০), ৪. অস্বাস্থ্যকর (১৫১-২০০), ৫. খুব অস্বাস্থ্যকর (২০১-৩০০) এবং ৬. অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর (৩০১-৫০০)। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম নিয়মিত নগরীর বিভিন্ন স্থানে নমুনা সংগ্রহ করে বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করে। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে, সাসপেনডেট পার্টিকুলেট ম্যাটার, অক্সাইড অব নাইট্রোজেন এবং সালফার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অত্যধিক বেশি।
চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ, পতেঙ্গা, কালুরঘাট, বায়েজিদ এবং এ.কে. খান এলাকায় প্রায় ২০০ ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। তাছাড়া এখানে নিয়োজিত লক্ষাধিক শ্রমিকের বাসা বাড়িতে রান্নার জন্য ব্যবহার কৃত জ্বালানীও বায়ুদূষণের মাত্রাকে বৃদ্ধি করছে।
বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মৃত্যু ঘটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং ২৫ শতাংশ ফুসফুস সমস্যাজনিত কারণে মারা যায়। হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। এর মধ্যে বেশির ভাগ আর নগর এলাকার। এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের জন্য ইটের ভাটা ৫৬% যানবাহনের ধোঁয়া ২৮% এবং সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধূলা থেকে ১৬% দায়ী। মূলত সবগুলো বিষয় নগরের সাথে জড়িত। নগর এলাকা মানুষের বাসস্থানের চাহিদা, শিল্প কারখানা স্থাপন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিপণী বিতান নির্মাণ সবগুলোর জন্য প্রতিনিয়ত ইটের প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে ঈঅঝঊ (ঈষবধহ অরৎ ধহফ ঝঁংঃধরহধনষব ঊহারৎড়হসবহঃ) প্রজেক্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ইট তৈরির প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫০৮টি এবং চট্টগ্রাম শহরের পাশর্^বর্তী এলাকায় ৪৩১টি রয়েছে। এসব ইট তৈরির প্রতিষ্ঠানে ইট তৈরিতে পোড়ানো হয় কাঠ, কয়লা, কাঠের গুঁড়া, ফার্নেস অয়েল এমন কি বাতিল টায়ার ও প্লাস্টিক। আবার ১ লাখ ইটপোড়াতে প্রায় ২০ টন কয়লার দরকার হয়। এই ইট তৈরি করতে গিয়ে অতিরিক্ত কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ যা দূষিত করছে সমগ্র বায়ুম-লকে।
দ্রুত হারে নগরায়নের জন্য ৬০ বর্গ মাইল আয়তনের চট্টগ্রাম শহরের ওপর ক্রমাগত আবাসনজনিত চাপ বাড়ছে। চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে প্রায় ১.৯ মিলিয়ন বাসস্থান রয়েছে। অন্যদিকে, প্রতি বছর প্রায় ৫% হারে চট্টগ্রামের নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগর জনসংখ্যার আবাসনের চাহিদাপূরণ করতে গিয়ে নগর এলাকায় পুরাতন ভবন ভাঙা, নতুন নির্মাণ ও ভবন নির্মাণ সামগ্রীর কারণেও বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার আবাসন তৈরির অন্যতম উপাদান ইট প্রস্তত করতে গিয়ে আগুন দ্বারা কাঠ- কয়লা পোড়াতে হয়, যা নগর এলাকার বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।
চট্টগ্রাম শহরে মানুষের অভিগমনের মূল লক্ষ্য থাকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি অথবা যে কোন পর্যায়ের ব্যবসা। কিন্ত পেশাগত যাতায়াতের ক্ষেত্রে পরিবহণ অন্যতম একটি মাধ্যম। চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবহণের চাপ ও ক্রমাগত বাড়ছে ।
বিআরটিএ’র মতে, চট্টগ্রাম শহরে দৈনিক ১০২৫টি বাস, ৭১০টি হিউম্যান হলার, ১৬২০ টি টেম্পো, ট্রাক ১৫২৪৫টি এবং প্রায় ৮০০০ সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল করে। মানুষ ও পণ্য-পরিবহণে চলাচলরত দৈনিক ২০ থেকে ২৫ হাজার গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড চট্টগ্রাম শহরের বায়ু দূষণের মাত্রাকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরে চলাচলরত ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো ও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।
অন্যদিকে, অপরিকল্পিতভাবে লাগানো ডিজিটাল বিলবোর্ড, যত্রতত্র ফটোকপির দোকান, শহর এলাকায় জলাশয় ভরাট, বৃষ্টি পাত্রের অসম-বণ্টন ও দীর্ঘদিন বৃষ্টিহীন অবস্থা প্রভৃতি বন্দর নগরীর মত বাণিজ্যিক রাজধানীর বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। তাছাড়া চট্টগ্রাম শহরের খাল, নালাসমূহ পরিষ্কার করার সময় বর্জ্যসমূহ রাস্তার পাশে স্তুূপ করে রাখা হয় এবং ডাস্টবিনের বর্জ্যগুলোর কারণেও শহরের নির্মল বায়ু হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর।
সুতরাং পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে শহরের মানুষ ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন কমাতে পারলে, পরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তার উন্নয়ন ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে, সকল সংস্থার সমম্বয় এবং বায়ুশোধন যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন করলে চট্টগ্রাম নগর এলাকায় দূষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
লেখক ঁ সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট