চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

নগরীর বাতাস কতটুকু নিরাপদ?

ড. অলক পাল এবং মো. আকিব জাবেদ

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

এই গ্রহে জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নিরাপদ বায়ু অপরিহার্য। নিরাপদ বায়ু হচ্ছে এমন বাতাস যাতে কোনও দূষণকারী ও ক্ষতিকারক গ্যাস অথবা ধূলাবালির উপস্থিতি নেই। কেবল মানুষ নয়, বন্যপ্রাণি, গাছপালা, ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নিরাপদ ও বিশুদ্ধ বাতাস নিশ্চিত করা অতীব প্রয়োজন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১১,০০০ হতে ২০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ ও ত্যাগ করে। কিন্তু এই অতি-প্রয়োজনীয় উপাদানটি সকল জীবের জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন এতে ক্ষতিকর ও বিষাক্ত উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটে।

চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী যেখানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। এই শহরের প্রায় ১০ বর্গ কি. মি. এলাকাজুড়ে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবহার নিয়মিত যানজটের সৃষ্টি করছে। শহরের প্রধান সংযোগ সড়কসমূহ বন্দর এলাকা হতে অন্যান্য শিল্প এলাকাকে সংযুক্ত করেছে। তাই অভ্যন্তরীণ এসব প্রশস্ত সড়কে প্রতিনিয়ত ভারিযানবাহন চলাচল করছে যা দেশে আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্য শহর ও দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ কাজে নিয়োজিত। তাছাড়া নগরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে নগরীর সড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে। অনুন্নত ও অপর্যাপ্ত গণপরিবহন ব্যবস্থার কারণে শহরে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা, যা নগরের বেশিরভাগ সড়কেই যানজটের সৃষ্টি করছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, নগরীতে চলাচলকারী বেশিরভাগ ভারি ও পুরানো ডিজেলচালিত যানবাহনগুলো কালো ধোঁয়া নির্গত করে। যা শহরের বাতাসকে ক্রমাগত দূষিত করছে। অন্যদিকে, শহরের অদূরে চারপাশে অবস্থিত ইটভাটা হতে নির্গত ধোঁয়া ও ধুলোবালি বাতাসের মাধ্যমে শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া, নির্মাণ সামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রাখা, সড়ক নির্মাণকাজে বিটুমিন গলানোর জন্য আগুনে সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়া, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে উন্মুক্ত বালি ও মাটি শহরব্যাপী বাতাসে অতিমাত্রায় ধুলোবালি সৃষ্টি করছে। উপরন্তু, নগরীতে অবস্থিত শিল্পএলাকাসমূহ যেমন কালুরঘাট, নাসিরাবাদ ও বায়েজিদের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান হতে প্রতিনিয়ত বাতাসে মিশছে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইডের মত বিষাক্ত গ্যাসসমূহ যা এই শহরের বাতাসকে ভারি করে তুলছে। মূলত শিল্প ও যানবাহন হতে নির্গত ধোঁয়াই বায়ুদূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের বায়ুতে ক্ষুদ্র ধূলিকণার পরিমাণ (ঝচগ) প্রতি ইউনিটে সর্বোচ্চ প্রায় ৫০০ মাইক্রোগ্রাম ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে সহনীয় মাত্রা হলো ২০০ মাইক্রোগ্রাম। যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গ্রহণযোগ্য মানের চেয়ে অনেক বেশি। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাতাসে ঝচগ এর মাত্রা শহরের আগ্রাবাদ, নিউ মার্কেট, একে খান গেট, পাহাড়তলী সড়কে অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। তাছাড়া অতিমাত্রায় যান চলাচলের কারণে মুরাদপুর, অক্সিজেন, জিইসি ও ২ নং গেট এলাকাও বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গেছে, বৃষ্টিপাত এবং বাতাসের গতির কারণে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম শহরে বায়ুদূষণ কম থাকে। অপরপক্ষে, কম বৃষ্টিপাত, নিম্ন তাপমাত্রা এবং বাতাসের গতিবেগ কম হওয়ার কারণে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বাতাসে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় আরো বলা হয়, রাতের বেলায় বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি হয়ে যায়। কারণ তাপমাত্রা হ্রাসের সাথে গ্যাসীয় দূষকগুলি মাটির কাছে নেমে আসে এবং দূষণ সৃষ্টিকারী বেশিরভাগ ডিজেলচালিত যানবাহনগুলি শহর অঞ্চলে সন্ধ্যা বা রাতের সময়ে চলাচল করে। সকালে যানবাহনের কম প্রবাহ এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে এটি আবার হ্রাস পায়। বিশুদ্ধ বায়ুর অপর্যাপ্ততার কারণে চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। চিকিৎসকদের মতে, যদি নিরাপদ বায়ু নিশ্চিত করা সম্ভব না হয় তবে মানুষের শারীরিক জটিলতা সময়ের সাথে আরো বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম শহরের বাতাসে যেহেতু ক্ষুদ্র ধূলিকণা অতিমাত্রায় উপস্থিতি প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করছে। ফলশ্রুতিতে তা ফুসফুসজনিত নানান রোগের সংক্রমণ করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ মানুষের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করছে, তন্মধ্যে ক্রমবর্ধমান হাঁপানি, অনিয়মিত হার্টবিট, ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস এবং শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাগুলো বৃদ্ধি যেমন শ্বাসনালীতে জ্বালা, কাশি বা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত মানুষের অকাল মৃত্যু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া, যানবাহন ও শিল্প হতে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড শরীরের অঙ্গগুলি (হার্ট এবং মস্তিষ্কের মতো) এবং টিস্যুগুলিতে অক্সিজেন সরবরাহ কমানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টি করে। বাস, ট্রাক এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত নাইট্রোজেন অক্সাইড মানুষের শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ এবং হাঁপানি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প কারখানাগুলো থেকে নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড ব্রঙ্কাইটিস ও হাঁপানির সৃষ্টি করতে পারে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রত্যেক প্রাণী বেঁচে থাকে আর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ বায়ু নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষের এই শহরের বাতাসকে দূষণমুক্ত করতে জরুরি ভিত্তিতেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং যথোপযুক্ত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সুপারিশ :
১) ফিটনেসবিহীন ও কালো ধোঁয়া সৃষ্টিকারী সকল যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা।
২) উন্মুক্ত স্থানে মাটি, বালি ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী ফেলে না রাখার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।
৩) শহরের অদূরে অবস্থিত সকল ইটভাটা অপসারণ করা।
৪) রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ হতে যেন কোনভাবেই ধুলোবালি না ছড়ায় তার জন্যে নিয়মিত পানি ছিটানো।
৫) দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারি শিল্প এলাকাকে নগরী হতে দূরে স্থাপনের ব্যবস্থা করা।
৬) ছোট শিল্পসমূহের মধ্যে যারা বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গত করে তাদের পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিল করা।
৭) গাছ বাতাসকে নির্মল ও পরিশুদ্ধ করে তাই শহরের অভ্যন্তরে ও প্রান্তে গ্রিনজোন বা সবুজ অঞ্চল গঠন করা।
৮) শহরের সকল উন্মুক্ত ডাস্টবিন উচ্ছেদ করা যা দুর্গন্ধের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বস্তির সৃষ্টি করে।
৯) নগরীর আবর্জনার স্তূপ বা ডাম্পিং সাইটে ময়লাপোড়ানো বন্ধ করা, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আবর্জনার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা যেতে পারে।
১০) শহর এলাকায় কাঠ, পলিথিন এসব পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা। এসকল উদ্যোগ নগরীকে একটি ক্লিন ও গ্রিন সিটি হিসেবে গড়তে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

লেখক ঁ ড. অলক পাল, অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং মো. আকিব জাবেদ, স্নাতকোত্তর ছাত্র, ইনস্টিটিউট ফর হাউজিং এন্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি রোটারডাম, নেদারল্যান্ড

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট