চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রমজানে ইবাদতের বাহক আল কোরআন

৩১ মার্চ, ২০২৩ | ১২:৩০ অপরাহ্ণ

রোজা ‘রিয়া’মুক্ত ইবাদত। অন্য ইবাদতের মধ্যে লোক দেখানো রিয়া পাওয়া যেতে পারে। নামাজ পড়ছেন আপনি অন্যরা দেখছেন। দান-সদকা অন্যরা দেখছে। কিন্তু রোজা দেখার সুযোগ নেই। আপনি রোজা রেখেছেন সেটা আপনিই জানেন। আল্লাহপাক লোক দেখানো বিষয় পছন্দ করেন না। তাই রিয়ামুক্ত ইবাদত বেশি কবুল হয়। সেই কারণে রাতের নামাজকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রিয়ামুক্ত হওয়ার কারণে। কেউ দেখছে না আপনি একাকী নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করছেন। দিনের ইবাদত সিয়াম, রাতের ইবাদত কিয়াম। সেই কারণে রোজাদাররা বিশেষ মর্যাদা পাবেন কেয়ামতের দিন।
পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারাহ এর ১৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আমানূ কুতিবা আলাইকুমুছ ছিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাযীনা মিন ক্বাবলিকুম লা আল্লাকুম তাত্তাকূন”। হে ঈমানদারগণ, যারা ঈমান এনেছ,তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো,যে রূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।
আল্লাহ এক মাস রোজা আমাদের উপর ফরজ করেছেন। এর কারণ হলো-রমজানে ইবাদতের মাধ্যমে যেন আমরা আল্লাহর রহমত, মাগফেরাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাই। রমজানের প্রথম ১০দিন রহমতের, মাঝের ১০দিন ক্ষমার এবং শেষের ১০দিন হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির । পুরো মাসজুড়ে রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি থাকলেও ওই ১০দিন ভাগ করে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন।
ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়। কোরআন খতমের পর দোয়া কবুল হয়। তাই আল্লাহর প্রিয় হাবিব বলেন, রোজাদারদের জন্য দুটি সুসংবাদ, দুটি খুশি রয়েছে। একটি খুশি হলো সে যখন ইফতার করবে, প্রফুল্লচিত্তে আল্লাহপাকের হুকুম আদায় করবে । সাথে সাথে সে সময় মানুষের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। তাই সে সময় মাগফেরাতের, ক্ষমার দোয়া বেশি করা হয়। আল্লাহপাক যেন আমার সমস্ত গুণাহগুলো ক্ষমা করে দেন।
কারণ গুণাহ ক্ষমা হলে আল্লাহপাক আপনাকে দুনিয়াতে এবং পরকালেও প্রশান্তি দেবেন। আত্নার জন্য শান্তি দেবেন। গুণাহর কারণে আপনার উপর বিপদ আসে। গুণাহর ক্ষমা পেলে অনেক সমস্যার সমাধান পাবেন। তাই রাসূল (সা) ইফতারের সময় দোয়া করতেন। হে, প্রশস্ত দয়াময় প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। ইফতার শেষেও দোয়া করবেন। কারণ সে সময় মানুষের দোয়া কুবল হয়।
রোজাদারদের জন্য আলাদা খুশির খবর হলো যখন হাশর হবে তখন আলাদা খাবারের ব্যবস্থা করবেন আল্লাহ। দস্তরখানা বিছিয়ে সেখানে কিছু মানুষ আহার গ্রহণ করবে। একে অপরকে জিজ্ঞেস করবে এরা কারা? তারা হলো দুনিয়ার মধ্যে রোজাদার। আল্লাহপাকের ভয়ে রোজা রাখার পুরস্কার এটি।
রমজান হলো কোরআনের মাস। বেশি বেশি কোরআন তেলওয়াত করবেন এবং তেলওয়াত শুনবেন। কারণ কোরআন তেলওয়াত করলে কিংবা তেলওয়াত শুনলে আল্লাহপাক আমাদের একটি পুরস্কার দেন । সেটি হলো ঈমান বাড়া। কোরআন শরীফে আল্লাহ বলেন, “মুমিনদের সামনে যখন কোরআন তেলওয়াত হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। আল্লাহ তাদের ঈমানকে বাড়িয়ে দেন। তাই কোরআন শুনলে ঈমান আলোকিত হবে। ঈমান বাড়লে আমলের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। দুর্বল ঈমানের কারণে অনেকের আমলে আগ্রহ নেই। তাই ঈমান বাড়াতে হলে অধিকহারে কোরআন তেলওয়াত করতে হবে, বিশেষ করে এই রমজান মাসে। কারণ এই মাসে ৭০গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে অন্য মাসের তুলনায়। কোরআন তেলওয়াত শুনলেও আপনার ভুলত্রুটি শুদ্ধ হবে। তাই সাহাবায়ে কেরাম রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তেলওয়াত করতেন। এই কোরআন পড়ে পড়ে তাদের ঈমান বাড়িয়েছেন।
আল কোরআন কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষত। এখানে কোন ধরণের পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজনের সুযোগ নেই। তাই এই কোরআনের কোন একটি আয়াত কেয়ামত পর্যন্ত পরিবর্তনযোগ্য নয়। কেয়ামত পর্যন্ত কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহপাক নিজেই নিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, আমি কোরআনকে অবতীর্ণ করলাম, এই কোরআনকে আমি হেফাজত করবো। আল্লাহপাক কোরআন মুখস্থ করাকে সহজ করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে আক্ষরিক অর্থে কোন কিতাব মুখস্থ করানো হয় তা দেখবেন না, একমাত্র কোরআন ছাড়া। আল্লাহপাক এই কোরআন মুখস্থ করাকে সহজ করে দিয়েছেন নসিহত হাসিল করার জন্য।
আল্লাহপাক নবীকে অনেক মুজেজা দান করেছেন। সব মুজেজার মধ্যে সেরা মুজেজা হলো কোরআনের মুজেজা। কারণ অন্যান্য মুজেজা ছিল সাময়িক। রাসূল (সা.)চাঁদকে দুই টুকরো করেছেন। দেখার পর শেষ। রাসূল (সা.) আঙ্গুল দিয়ে পানি বের করেছেন। সমস্যা সমাধানের পর শেষ। রাসূল (সা.)দুধে থু থু নিক্ষেপ করার পর একজনের দুধ হাজারজন পান করতে পেরেছেন। এসব সাময়িক সময়ের জন্য অলৌকিক ঘটনা হলেও কেয়ামত পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ কোরআন।
আল্লাহপাক কোরআনের শুরুতে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, এই কোরআনের মধ্যে যদি কোন সন্দেহ থাকে একটি ছোট সূরার মতো সূরা আন, ছোট্ট সূরা রচনা কর। তোমাদের সন্দেহ হলে কোরআনের মতো একটি কোরআন রচনা কর। আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর সকল থেকে সহযোগিতা নাও। এবং তা পারেনি মক্কার কাফেরগণ। তারপর বলেন, কোরআন বাদ দাও । তাহলে একটি সূরা রচনা করে দেখাও তাও পারেনি। পরিশেষে আল্লাহপাক চ্যালেঞ্জ দেন যে তাহলে তোমরা একটি আয়াত রচনা কর। কিন্তু তারা পারেনি। শেষে আল্লাহপাক বলেন, কোরআনের মোকাবেলা তোমরা কেয়ামত পর্যন্ত করতে পারবে না। তাহলে তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচ। জাহান্নামকে তোমরা ভয় কর। যেই জাহান্নাম কাফিরদের জন্য আল্লাহ তৈরি করেছেন।
কোরআন দেখতে ছোট হলেও লাখ লাখ পৃষ্ঠা লেখা হলেও এর অর্থ শেষ হবে না। এর শব্দ কম অর্থ বেশি। এটাই হলো আল্লাহপাকের কালামের মুজেজা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত কিতাব হলো কোরআন। অন্যান্য আসমানি কিতাব বিকৃত হয়ে গেছে কোরআন বিকৃত হওয়ার সুযোগ নেই। কেয়ামত পর্যন্ত এই কোরআন মানুষের জীবন বিধান।
আল্লাহর প্রিয় হাবিব বিদায় হজ্বের সময়ের মধ্যে বলেছেন, আমি তোমাদের ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি। তোমার যাতে পথভ্রষ্ট না হও দুটি বিষয় রেখে গেলাম। একটি হলো আল্লাহপাকের কোরআন, অপরটি হলো আল্লাহর রাসূল (সা.)এর হাদীস। তাই যে মত কোরআন এবং সুন্নাহ মতো হবে তা হলো দ্বীন। আর কোরআন এবং সুন্নাহর বাইরে যা আসবে তা কুসংস্কার, পাপ অথবা বিদয়াত ভ্রান্ত পথ। রাসূল (সা.)এক সময় বৃত্ত অংকন করেন এবং চারপাশে তিনি আঁকা বাঁকা রেখা টানেন। তা দেখিয়ে সাহাবায়ে কেরামদের বলেন, মাঝখানের যে পথ সেটা হলো কোরআন এবং সুন্নাহর পথ। এটাই হলো সিরাতুম মুস্তাকিম । আশপাশের বক্রাকার রেখা হলো ভ্রান্ত পথ। এগুলো মানুষকে পথভ্রমষ্টতার পথ। তোমরা কোরআন এবং সুন্নাহর পথ গ্রহণ কর।
আল্লাহ কোরআনকে রমজানের জন্য ইবাদতের বাহক বানিয়ে দিয়েছেন। মানুষ নামাজ ছাড়া যেমনি রমজানে কোরআন তেলওয়াত করবে তেমনি তারাবির মধ্যেও কোরআন তেলওয়াত করবে। ঠিক তেমনি তাহাজ্জুদের মধ্যেও কোরআন তেলওয়াত করবে। সাহাবায়ে কেরাম রমজানের রাতে দীর্ঘ সময় ধরে ইবাদত করতেন।
বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলওয়াত করা ফরজ। পুরো কোরআন মুখস্থ করা মোস্তাহাব। যতটুকু পড়লে আপনার ৫ ওয়াক্ত নামাজ সহীহ হবে ততটুকু শুদ্ধভাবে পড়তে হবে। কিন্তু কমপক্ষে এতটুকু আপনাকে মুখস্থ করতে হবে যাতে শুদ্ধভাবে নামাজ পড়তে পারেন। তারবির নামাজ আদায় করতে পারেন। ২০ থেকে ৩০টি সূরা বিশুদ্ধভাবে পড়ে নিতে হবে। আপনি মুখস্থ করেছেন ঠিক কিন্তু ‍বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারেন না তাহলে আপনার নামাজ হবে না রহমতও আসবে না। বরং বিশুদ্ধভাবে পড়তে না পারলে, ভুল পড়লে আপনার উপর কোরআন তেলওয়াতের রহমত না এসে অভিশাপ আসবে। তাই সেই কারণে যে কোন একজন বিশুদ্ধ তেলওয়াত কারীর মাধ্যমে ব্যাক্তিগতভাবে হলেও কোরআন পড়া শুদ্ধ করে নেয়া ফরজ।
আল্লাহর কাছে বলতে পারবেন না নামাজে কোরআন তেলওয়াত না জেনে ভুল করেছি। এভাবে ওযর করলে হবে না, কারণ শিশুকালে মা-বাবা অবহেলা করলেও বালক হওয়ার পর দায়িত্ব আপনার। আল্লাহ বলবেন, মা-বাবাকে শাস্তি দিলাম না শেখানোর জন্য বালক হওয়ার আগে। পরে নিজের দায়িত্বে কোরআন শিখা তোমার উপর ফরজ ছিল। কমপক্ষে ১১টি সূরা হলেও বিশুদ্ধভাবে তেলওয়াত করতে হবে। বয়স ১০০হলেও কোন ওযর কাজে আসবে না। নামাজে কোরআন দেখে পড়ারও কোন সুযোগ নেই।
আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার সাথে যেভাবে আচরণ করেন। আমি তার সাথে সেভাবে আচরণ করি। কেউ যদি মনে করেন তিনি চুরি না করলে চলতে পারবেন না। তখন আল্লাহ তাকে চুরি করে চলার ব্যবস্থা করেন। পরে জাহান্নাম দেবেন। কেউ যদি মনে করে যে, চুরি না করলেও আল্লাহ আমাকে চালাবেন। তখন আল্লাহ তাকওয়ার কারনে অজানা পথে তার রিজিকের ব্যবস্থা করেন।
রমজানে আল্লাহর ভয়ে মানুষ যাবতীয় পানাহার এবং হারাম থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে এই রমজান মাসে ইবাদত করার তৌফিক দিন। আমিন।

 

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট