চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শেষ হোক গুজবের গজব

শেষ হোক গুজবের গজব

শাহীন হাসনাত

১৩ নভেম্বর, ২০২০ | ৪:৩৬ অপরাহ্ণ

হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘শপথ সেই মহান সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ। দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না (তার আগে) মানুষের প্রতি এমন এক সময় আসবে, হত্যাকারী জানবে না সে কেন হত্যা করছে, আর নিহত ব্যক্তি জানবে না তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। বলা হলো, সেটা কীভাবে হবে? বললেন, হারাজ (গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ইত্যাদি)-এর কারণে।’ -সহিহ মুসলিম: ৩৯০৮

হাদিসের কথা মিলে যাচ্ছে, আসলেই গুজবের শিকার হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি জানে না, কোন অপরাধে তাকে মারা হচ্ছে। আর যারা মারছে তারাও জানে না, কেন তাকে মারছে। এভাবেই গুজবে ভর করে কোনো ঘটনার সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করে নিরপরাধ মানুষকে কখনো পিটিয়ে, কখনো আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। নিকট অতীতে ছেলেধরা গুজবে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। রাজধানীতে সন্তানের স্কুলের খোঁজ নিতে গিয়ে তাসলিমা বেগম নামে এক মাকে জীবন দিতে হয়েছে। গুজব কখনো আনন্দের বার্তা দেয় না। গুজব সবসময়ই নিষ্ঠুর, অমানবিক, হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। গুজবের কারণে বাংলাদেশের নানা জনপদ, সম্প্রদায়, শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এসব কিছু জানার পরও মানুষ গুজবের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআন অবমাননার অভিযোগে শহীদুন্নবী জুয়েল নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে লাশ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, অভিযুক্তদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তবে এখনো প্রমাণ মেলেনি জুয়েল কর্তৃক পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে।

বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের দায় ইসলাম কখনোই নেবে না। ইসলামে অবশ্যই অবমাননার-অন্যায়ের শাস্তি আছে। কিন্তু এভাবে হুটহাট, যাচাই-বাছাই ছাড়া গণপিটুনি দিয়ে নয়। ইসলাম জোর-জবরদস্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসলাম প্রচার-প্রসার ঘটেছে ভালোবাসায়, মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে পরম মমতা, গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায়। মেহেরবান আল্লাহ মানুষ তো দূরের কথা, একটা মশাকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেননি। যুদ্ধ ও আত্মরক্ষা ছাড়া কাউকে আঘাত করা ইসলাম সমর্থন করে না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা থাকলেও ইসলামমনস্ক পরিবারের সন্তান ছিলেন জুয়েল। ফজরের নামাজ আদায় করে এলাকার রাস্তা পরিষ্কার করতেন। জুয়েলের ঘরে প্রচুর ইসলামি বই, কোরআন শরিফ ও তাফসির রয়েছে। পরিবারের দাবি, মানসিকভাবে অসুস্থ হলেও জুয়েল কোরআন অবমাননার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে না। ইসলামি স্কলারদের মতে, শিশু, চেতনাহীন, মানসিক ভারসাম্যহীন ও পাগলদের আমলনামা লেখা হয় না। কারণ, তারা নিজের ইচ্ছাতে কিংবা সজ্ঞানে কিছুই করে না। তাই তাদের ওপর শরিয়তের কোনো হুকুম প্রযোজ্য নয়। এটা ঠিক যে, ধর্ম ও কোরআন অবমাননা মেনে নেওয়ার মতো বিষয় নয়, তবে কোনো ঘটনা প্রকাশ পেলে সেটা গুজব; নাকি সেখানে কোনো ষড়যন্ত্র আছে তা সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে। প্রতিকারে প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। ধর্ম অবমাননা অবশ্যই গর্হিত কাজ। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেউ ব্যঙ্গবিদ্রুপ কিংবা গালিগালাজ করলে মুসলমানদের মন কাঁদে, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। পবিত্র কোরআনের অবমাননা করলে মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এহেন মুহূর্তে ধৈর্য ও ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। রাসুলের সময়ে কি তাকে অসম্মান, গালাগালি কিংবা কোরআনকে অবমাননা করা হয়নি? সে সময় কি নবী করিম (সা.) ওই সব ইহুদি-নাসারা কিংবা কাফেরদের পিটিয়ে মেরেছিলেন? আমরা প্রতিবাদ করব, ঘৃণা করব- কিন্তু আমরা কি হত্যা করতে পারব? বর্বর আচরণে কি ধার্মিকতা প্রকাশ পায়?

ইসলাম শান্তির ধর্ম। নবী করিম (সা.) বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর আল্লাহতায়ালা বলেছিলেন, ‘হে নবী! আপনি একবার বলুন, আমি এই সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেব। কিন্তু দয়াময় রাসুল (সা.) ধ্বংস না চেয়ে তাদের হেদায়েত কামনা করেছিলেন।’ ইসলাম আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। দেশে নানা ধরনের গুজব হাওয়ায় ভাসে। ধর্মীয় অবমাননা ও পণ্যের দাম বৃদ্ধির গুজব মহামারীর রূপ নিয়েছে। গুজবের সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে একশ্রেণির মানুষ নানান ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। নিকট অতীতে লবণ সংক্রান্ত গুজব, ছেলেধরা গুজব, পদ্মা সেতুতে মাথা লাগানোর গুজব, হারপিক গুজব কিংবা করোনাভাইরাস ঠেকাতে নানা টোটকার গুজব ছড়ানো হয়েছে। আগে গুজব নির্দিষ্ট এলাকা কিংবা অঞ্চল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে পুরো দেশই গুজবের শিকার হচ্ছে। বানের পানির মতো গুজব আসে এবং ছড়ায়। সেগুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। গুজব প্রতিরোধে সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত শিক্ষার প্রসার বাড়ানোর পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদের কঠিন বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই গুজবের গজব ও নিষ্ঠুরতা থেকে জাতি রক্ষা পাবে।

 

লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট