চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

এখনই সময় অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

৪ জুন, ২০২০ | ৪:৫৯ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ। চলছে করোনাকাল। লকডাউন বন্দিদশায় । জানালা পাশে লেখার টেবিলে বসে ভাবছি।এই সমুদ্র নগরে বাহিরে বইছে পূর্বদিকপ্রান্ত হতে সমুদ্র ঢেউকে দলিত মথিত করে বেগবান বারিগর্ভ হাওয়া। আসছে এলো বৃষ্টি, শুধুই বৃষ্টি। তর্জন গর্জন সমুদ্র স্রোতের। পঞ্চমস্তক নাগ ফণা মহাজাগতিক মহাসাগরের সর্প নাগের ফণার মতন ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। উড়ন্ত মৈনাগগিরির বিপুলাকার রূপ। ঘন নীলবর্ণের মেঘ ঢেকে দিল প্রকৃতি। সমুদ্র সৈকতনগর আজ পর্যটক শূন্য। কোথাও নেই তাদের গতায়াত। হোটেল- সৈকত- নগর মুখরিত আজি মেঘরাজের উন্মুক্ত চুম্বনে। সারাবিশ্বে মানুষ করোনায় বন্ধি। চারিদিকে ভয়াবহ চিত্র মৃত্যুমিছিল। এ হতে পারে কোন পরাশক্তির ষড়যন্ত্র।
আসলে এ যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ। মনে কি পড়ে গত বছরগুলোতে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো কিভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিল, যুদ্ধ মানবতার চরম বিপর্যয়ে। পৌঁছে গিয়েছিলো পারমাণবিক যুদ্ধের সন্নিকটে। সিরিয়ার মানুষের করুন মৃত্যুর আর্তনাদ। অভুক্ত শিশুর মৃত্যুর কান্না। দুইটি মাস্ক। রাসায়নিক বোমার আঘাতে শ্বাস নিতে কষ্ট, ভাই পরম মমতায় নিজের মাস্ক খুলে পরিয়ে দেয় ছোট্ট বোনের মুখে, ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। উদ্ধারকারী দল হাস্যরত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে, যেন মৃত্যুর আগে হেসে সে পরিহাস করে গেলো এই মানবসভ্যতাকে। পরাশক্তির লোভকে, হিংসা বিদ্বেষকে। আজ তাদের মাস্ক প্রয়োজন। মনে কি পড়ে সিরিয়ার সে মৃত্যুর মিছিলের কথা। বিষাক্ত গ্যাস, এতটুকু বাতাসের অভাবে মৃত্যু। ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য সমুদ্র পথে মানুষের কত চেষ্টা। তারা স্থান দেয়নি। ক্ষুধায়, তেষ্টায় তাদের মৃত্যু হয়।
মনে কি পড়ে, সমুদ্রের সৈকতে ভেসে থাকা সে ছোট্ট মৃত শিশুর কথা। ইয়েমেনের রুমাহ শহরের ১৯ বছর বয়সী মুনতাহা লিখেছিলো, ”গত ১৮ ঘণ্টায় এখানে খাবার পানি আসেনি। আমি গত ১ দিন আগে শেষ রুটি খেয়েছি। আজ সকালে দু’টো খেজুর, দুপুরে এখন পর্যন্ত কিছু খাইনি। অনেক কষ্ট করে এখানে হেঁটে এসে একজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের অনেক হাত পা ধরে আপনাকে এই মেইল পাঠাচ্ছি। বাবা-মা দাঁড়াতে পারে না। গত এক সপ্তাহ ধরে চার পায়ের জন্তুর মত মাটিতে হাঁটে, এত ক্ষুধা তাদের। গত কয়েক সপ্তাহ টক গাছের পাতা সিদ্ধ করে ভর্তা করে খেয়েছিলাম। এখন সে পাহাড়ের গাছগুলোর পাতা ও শেষ হয়ে গেছে। সামনে রমাদান আসছে! জানিনা কিভাবে সাহরি করব কি দিয়ে ইফতার করব!! আপনারা যারা এসেছিলেন যদি দয়া করে রমাদানের আগে আরেকবার আসেন! অন্তত একটু খাবার পানি নিয়ে আসেন! অথবা, ৫কেজি আটা দেন যাতে আমি, আমার মা আর বাবা রমাদানের রোজাগুলো রাখতে পারি। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, যদি আল্লাহ আকাশ থেকে কোন খাবার পাঠাতো! আমাদের দুঃখ গুলো শুধু আমাদের আশপাশের পাহাড় ছাড়া কেউ দেখেনা। “ আমার দেশগুলোর লোভী দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সীমাহীন লুটপাট। ব্যাংক লুট, নারী শিশু ধর্ষণ নির্যাতন, কিছু ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদের, দোসরদের মিথ্যা অহমিকা, শ্রমিক ও কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন আত্মসাৎ মালিকের, লাম্পট্য, আবার তারাই ভন্ড সমাজসেবক। ধর্ম নিয়ে অধর্ম পৌঁছে গিয়েছিল চরমে, মানুষের মনুষ্যত্ব দিন দিন কমছিল। আজ আমরা কি দেখছি না মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া, মৃত্যুর পর স্ত্রী পুত্র সংসার সমাজ স্পর্শ করছে না। করোনা আক্রান্ত ছুটছে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। আশ্রয় চিকিৎসা নেই। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। লাশ হয়ে পড়ে থাকা রাস্তায়। স্ত্রী, পুত্র,‌ কন্যা সন্তান, পরিবার- সমাজ কারো শেষ দর্শনের উপায় নেই। আজ বর্তমান মানবসভ্যতাও বাঁচার জন্য, এতটুকু শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু প্রতিদিন মানবতার যে নিষ্ঠুর মৃত্যু হয়েছে তা হতে আমাদের মুক্তি কোথায়। আমরা কেউ অংশ নিয়েছি, কেউ নিশ্চুপ থেকেছি, কেউ তামাশা করেছি। প্রতিবাদ কেউ করিনি। অভিশাপ হতে মুক্তি নেই। আজ আমরা মুখ ঢাকছি। অর্থ , বিত্ত, লাম্পট্য , রাজনীতি নামে ভণ্ডামি, লুটপাট, নারী শিশু নির্যাতন, ক্ষমতা দাপট, পরাশক্তির অস্ত্র মহড়া সবই মূল্যহীন। বাহিরে যাওয়া বারণ। সবসময় ভয়-আতংক। একটি ঔষধের অপেক্ষায়। আজ রাশিয়া আমেরিকায় চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো , ব্রিটিশরা হাহাকার করছে, সাথে সারা মানবজাতি।
আজ মানবসভ্যতা গৃহবন্দি, প্রকৃতি দিল অবসর, একটুও ভাবার ভালো মন্দের ভেদাভেদের, জাগ্রত করতে মানবতা মানুষের মাঝে। গৃহবন্দি মানুষ আর প্রকৃতি মুক্ত। ডলফিন সাঁতার কাটছে সৈকতে, সাগরলতা ফুলে ভরা সৈকত, লাল কাঁকড়া ঝাঁক, কচ্ছপ সৈকতে ডিম পাড়ায় ব্যস্ত। বিভিন্ন দেশে শহরে আজ বন্যপ্রাণীর প্রকাশ্যে বিচরণ, পাখির সরব কলরব, যে প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত আমরা অপরিষ্কার করেছি তাকে আজ পরিষ্কারে ব্যস্ত। যতটুকু দৃষ্টিপাত নিবিড় ঘন শ্যামলিমার বিপুল আয়োজন, সবুজ সজীব বৃক্ষ, হাওয়ায় আন্দোলিত। দূর পাহাড়ের নগর পথের প্রান্তরে বীথিকায় উদ্দ্যানগুলো উচ্ছিত সবুজে, ভারে ভারে সবুজ বহু রঙে বর্ণ ছায়ায়, নতুন কদলী পত্রের সবুজ থরে বিথরে। প্রকৃতি সজীব পরিচ্ছন্ন সহর্ষ প্রাণময়। সমুদ্র বহমান জলরাশি, দূর বহু দূর দুষ্ট পাখির মিষ্টি গান, যৌবনে মত্ত কোকিলের কুহুতান, কে বলে কোকিল শুধু বসন্তে ডাকে! যৌবনে মত্ত কোকিল সকল ঋতুতে ডাকে।
শ্রদ্ধেয় মানবিক পুলিশ, প্রশাসন , জীবন বাজি রেখে করোনা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে। শ্রদ্ধেয় সকল ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত সকলে শত বৈরী পরিবেশে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সেবা দিতে ব্যস্ত। তরুণ প্রজন্ম তার তারুণ্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত স্বেচ্ছাশ্রমে ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যস্ত। এই তরুণ, যুবা, মানবিক ভিক্ষুক, ডাক্তার, আর্মি, মানবিক পুলিশ, প্রশাসন তাদের মাতাপিতা, স্ত্রী, স্বামী, পুত্র কন্যা পরিবার গৃহে রেখে এই মহান দায়িত্বে ব্যস্ত। গৃহে তাদের মাতা পিতা , স্ত্রী, স্বামী, পুত্র কন্যা পরিবার বুক ধুকধুক চরম অনিশ্চয়তায় থাকে অপেক্ষায় প্রতীক্ষায়। আমাদের সরকারের এত এত যুগোপযোগী ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ। সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্বে সরকারের সকল বিভাগ, মানবিক পুলিশ প্রশাসন ও অন্যান্য সকল বাহিনী, আমাদের অহংকার অকুতোভয় ডাক্তার ও সেবা সৈনিকরা কাজ করে যাচ্ছে এই মহামারী মোকাবিলায়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো মাঠে- রাস্তায় এই রোদ্দুর মাঝে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।
আমরা আমেরিকা, ইউরোপীয় নই। আমরা বাঙালি। আমরা আমাদের সরকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পুলিশ প্রশাসন, সকল বিভাগ সবার ওপরে ভরসা রাখতে চাই, নিশ্চিন্ত থাকতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। শুধু এসময় নয় সবসময় মহাদুর্যোগে মানুষ ঘরে আশ্রয় নেয় বা নিরাপদ স্থানে, পরিবারের সাথে নিরাপদে থাকতে চায়, ঠিক তখনই অকুতোভয় বীর তারা তাদের আপনজন প্রিয় মুখ পেছনে ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। করোনার সম্মুখ যোদ্ধা ডাক্তারদের আন্তরিক শুভেচ্ছা, কৃতজ্ঞতা ও হাজার সালাম জানাই। তেমনই আমাদের অহংকার মানবিক পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ, জানাই হাজার সালাম। । সবাই যখন রাস্তায় তখন দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুটপাটকারী, শ্রমিক ও কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন আত্মসাৎকারী, ধর্ষক নারী শিশু নির্যাতনকারী, ত্রাণ লুটপাটকারী, ভন্ড মানবতাবাদী সমাজসেবক রাজনীতিবিদ, মিথ্যাচারকারীরা কি লজ্জিত হচ্ছেন না? তাদের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না? এখন সময় ঐক্যবদ্ধ মানবতার।  পূজো-ঈদের এবং নিজের পরিবারের বিলাসিতার অর্থ বাঁচিয়ে ক্ষুধার্ত- অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।
পূর্বকোণ/ এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট