চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ডাক্তার সমিরুল, দ্রুত ফিরে আসুন

সাইফুল আলম # ছবি: আলীউর রহমান

২৬ মে, ২০২০ | ২:৪৫ অপরাহ্ণ

একজন চিকিৎসকের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) অর্থপেডিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সমিরুল ইসলাম তার অনন্য দৃষ্টান্ত। ২০১৫ সালে আমার বাবার চিকিৎসা নিতে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করালাম। সেখানেই আমার সঙ্গে পরিচয়।

যেদিন আমার বাবার অপারেশনের তারিখ পড়ল, আগের দিন রাতেই জানিয়ে দিলেন- সকালে অপারেশন হবে। আমি যাতে সাড়ে ৯টার মধ্যে হাসপাতালে চলে আসি। এক সময় বাবার অপারেশনের সময় এল। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করতে করতেই উদ্দেশ্যহীনভাবে হাসপাতালের এদিক- ওদিক পায়চারি করছি। এর মধ্যেই ফোনে শুনলাম, ডা. সমিরুল হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছেন। দ্রুত অপারেশন থিয়েটারের সামনে গেলাম। আামাকে প্রায় ভেতরে নিয়ে গিয়ে দূর থেকে টিভি স্ক্রিনে দেখালেন- অপারেশন কত সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। কি খুশি তার চোখে মুখে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরে এলাম। রাতে কেবিনে অপারেশন পরবর্তী সময় পার করছি, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার বাবা অনেকটা নিথর হয়ে পড়ছেন। চাদর সরিয়ে দেখলাম শরীরের পেছনে অপারেশনের জায়গা থেকে রক্ত ঝরে ঝরে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। দৌড়ে ওই বিভাগে গেলাম। কর্তব্যরত চিকিৎসককে জানালাম। উনি আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করে আসছি- আসবো, এমন ভাব করে বসে রইলেন।

মন কিছুতেই মানছে না। দ্রুত কল দিলাম ডা. সমিরুল ইসলামকে, যিনি আব্বার অপারেশন করালেন। মুহুর্তেই দেখি তিনি ৫ তলায় এসে হাজির। পাশ ঘুরিয়ে বাবাকে ভাল করে দেখলেন। উনি এসেছেন শুনে নিচ তলার অর্থপেডিক বিভাগের জুনিয়র ডাক্তারও ছুটে এলেন। তাদেরকে দেখে ডা. সমিরুল বকাঝকা শুরু করলেন। বললেন, দুপুরে রোগীটার বড় (মেজর) অপারেশন এত সুন্দরভাবে করালাম। অথচ, ৭/৮ ঘণ্টা পরও তোমাদের (জুনিয়র ডিউটি চিকিৎসক) একটুও মনে হল না, রোগীটাকে একটু দেখে আসি! আহা…  । আর দেরি করলেন না, নিজেই কল করে আয়া ডেকে আনলেন। তারপর নিজেই ঠেলে ঠেলে আব্বার চলন্ত বিছানা দু’তলার একটি রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে সম্ভবত অপারেশন পরবর্তী জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। অক্সিজেন মাস্ক এবং হাতের আঙ্গুলে ক্লিপের মতো কিছু একটা লাগিয়ে পাশের একটি মনিটরে যুক্ত করে কিছুক্ষণ দেখলেন। বললেন, ‘হায়াত- মউত আল্লাহর হাতে। ভাল করে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিয়েছি। নতুন কিছু ঔষধও দিলাম। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। রাতটা যদি ভালোয়-ভাল কাটে তাহলে তিনি ঝুঁকিমুক্ত।’

হাঁটতে হাঁটতে নিচে এগিয়ে দিতে গিয়ে শুনছি- ব্যক্তিগত চেম্বার থেকে বার বার কল আসছে, বহু রোগীরা বসে আছেন। দ্রুত যাওয়ার জন্য এটেন্ডেন্টরা তাগাদা দিচ্ছেন। এত ব্যস্ততম একজন চিকিৎসক ‘আয়ের ধান্ধা’ ত্যাগ করে একজন সংকটাপন্ন রোগীর জন্য কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন- সেটি তুলে ধরতেই কম্পিউটারের কি বোর্ড নিয়ে বসলাম।

বাবার সুস্থতার পর বহু রোগী পাঠিয়েছি- আমার রেফারেন্সে গেলেই উনি ভিজিট নেন না। এটা শুনে বিব্রত হই। টাকা না নেয়ার কারণ জানতে চাইলেই বলেন, যান…. পরে কথা হবে। এত অমায়িক, মিষ্টভাষী, রোগীবান্ধব এক কথায় ভাল মানুষের যত রকমের গুণাবলী থাকা দরকার ডাক্তার সমিরুলের মধ্যে সবই দেখলাম। এমন চিকিৎসক আমার জীবনে আরেকজন পাইনি।

একদিন দেখলাম, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে কোথাও যাচ্ছেন, সামনের কোন রোগী হয়তো ওয়ার্ড অথবা কাউকে খুঁজছেন। নিজেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কি সমস্যা? তারপর নিজের বিভাগের না হলেও অন্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে অসহায় রোগীকে কর্তব্যরত চিকিৎসকের হাতে তুলে দিলেন। বয়সে ছোট, তাকেই অনুরোধ করলেন- একটু ভাল করে দেখ। অবাকই হলাম- এমন মহানুভব চিকিৎসক এ যুগেও আছে, ভাবা যায়?

আজ শুনলাম, তিনি করোনা আক্রান্ত। হয়তো রোগীদের সেবা করতে গিয়েই নিজে আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বসে দিন কাটছে তাঁর। ঈদের দিনও কেটেছে হাসপাতালেই। পরিচিত কাউকে সেই রুমের সামনে দেখলে হাত উঁচিয়ে সাড়া দিচ্ছেন। ইশারায় হয়তো বলছেন- চিন্তা করবেন না। ভাল আছি। দোয়া করবেন, ফিরে আসছি আবার আপনাদের মাঝে।

হ্যাঁ ডা. সমিরুল, আপনাকে ফিরে আসতেই হবে রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য। আসুন, আমরা সকলেই এমন মহৎপ্রাণ চিকিৎসকের দ্রুত সুস্থতার জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক পূর্বকোণ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট