চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

মুসলিম ইতিহাসে ধর্মীয় সহাবস্থান

অনলাইন

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১১:০৫ অপরাহ্ণ

মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলামি বিধিবিধান প্রণীত হয় মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। আর্তপীড়িত মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করতে। রাসুল (সা.)-এর মিশন ছিল, দুনিয়ার তাবৎ জনগোষ্ঠীর হারানো অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে ন্যায়নীতি ও ইনসাফ ফিরিয়ে আনতে রাসুল (সা.) নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। মানবতার মুক্তিই ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। যেটি বাস্তবায়নে তিনি মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। কোরআনের নির্দেশনা মেনে প্রণয়ন করেন সনদ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি-বাড়াবাড়ি নেই।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৬)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেনি, স্বদেশ থেকে যারা তোমাদের বিতাড়িত করেনি, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ০৮)

মুক্তি ও কল্যাণের নিশ্চয়তা

মদিনা সনদ মদিনার অধিবাসীদের মুক্তি ও কল্যাণের সনদে পরিণত হয়। এ সনদের নীতি ছিল, ধর্ম-বংশ নির্বিশেষে সব নাগরিকের প্রতি সুবিচার করা এবং প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইমাম রাজি (মৃত্যু : ৪৭৪ হি.) মদিনা সংবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘নবীজির (সা.) স্পষ্ট ঘোষণা ছিল মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি-সমষ্টি পার্থিব ও অপার্থিব সব বিষয়ে কাজ করবেন।’

মদিনার সনদের মূলনীতি ধর্ম কিংবা বংশের ভিত্তিতে ছিল না; বরং নাগরিকত্বের ভিত্তিতে ছিল। কোনো ইহুদি অসুস্থ হলে নবীজি তাকে দেখতে যেতেন। খোঁজখবর নিতেন। তাদের জানাজায় উপস্থিত হতেন। তাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতেন। নবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় দেখা যায়, তার বর্মটা এক ইহুদি ব্যবসায়ীর কাছে বন্ধক রয়েছে। কারণ নবীজি (সা.) তার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর কাছে খ্রিস্টান অতিথি

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘নবম হিজরিতে মহানবী (সা.)-এর কাছে নাজরান থেকে কিছু মেহমান আসে। তারা চৌদ্দ জন ছিলেন। নবীজি (সা.) তাদের মসজিদে নববিতে বসতে দেন। ইতিমধ্যে তাদের প্রার্থনার সময় হয়ে গেলে তারা মসজিদে তা আদায় করে। এ ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। আহলে কিতাবের জন্য মুসলমানদের মসজিদে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই। যদি কোনো ইহুদি ও খ্রিস্টান ভালো কাজ করে, নবীজি তাদের জন্য কল্যাণের দোয়া করতে বলেছেন।

ইমাম জাহাবি (মৃত্যু : ৭৪৯ হি.) আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো ইহুদি-খ্রিস্টানের জন্য দোয়া করবে তখন বলবে, আল্লাহ তোমার সন্তান ও সম্পদে বরকত দিন।’

অমুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনাকে গুরুত্ব

নবীজির এই শিক্ষা ধারণ করে সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়িন ও পরবর্তী যুগের মুসলিমরা পথ চলেছেন। বিজিত অঞ্চলের মানুষের প্রাণ, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। অমুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনা ও ধর্মগুরুদের সম্মান করেছেন। অমুসলিমদের ধর্মীয় আচার-নীতি স্বাধীনভাবে পালনের সুযোগ দিয়েছেন। অনেক সময় তাদের লোককে বিচারক বানিয়েছেন। ইহুদিদের কেউ কেউ প্রধান বিচারপতিও হয়েছিলেন। যাকে তৎকালীন পরিভাষায় ‘নাজিদ’ বলা হতো।

ইবনে কাসির (মৃত্যু : ৭৭৪ হি.) বর্ণনা করেছেন, দামেশকে প্রায় সত্তর বছর ধরে মুসলিম ও খ্রিস্টানরা একসঙ্গে একটি প্রার্থনালয় ব্যবহার করেছে।  সবাই এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করত; তবে ভিন্ন দরজা দিয়ে বের হতো। খ্রিস্টানরা পশ্চিম দিকের দরজা আর মুসলিমরা ডান দিকের দরজা ব্যবহার করত। পরবর্তী সময়ে ৮৬ হিজরিতে উভয় গোষ্ঠীর সম্মতিতেই প্রার্থনালয়টি মুসলমানরা এককভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। আর খ্রিস্টানরা অন্যত্র গির্জা তৈরি করে নেয়। সেই মসজিদটি এখনো অক্ষুণœ আছে। আর তা হলো দামেশকের বিখ্যাত উমাইয়া জামে মসজিদ।

পারস্পরিক জ্ঞান বিনিময়

ইসলামি শাসনামলে মুসলিম ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মাঝে জ্ঞান-শিক্ষার বিনিময় হতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে অনেক মুসলিম ইহুদিদের কাছে শিক্ষালাভ করেছিল। সাধারণত ইসলামের মূল আকিদা-বিশ্বাস ও মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন জ্ঞানের চর্চা হতো বেশি। বিশিষ্ট তাফসিরকারক মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইহুদি-খ্রিস্টানদের কিতাবে উল্লিখিত কোরআনসংক্রান্ত ব্যাপারগুলো তাদের কাছেই শিখেছেন।

২৩৫ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল একটি আদেশ জারি করেন, ‘এখন থেকে ইহুদি-খ্রিস্টানের কোনো বাচ্চাই মুসলমানদের সঙ্গে পড়তে পারবে না।’ বোঝা যায়, এর আগে একসঙ্গে পড়াশোনার বন্দোবস্ত ছিল।

শুধু যে জ্ঞানচর্চার জন্য একে অপরের কাছে যেতেন তাই নয়; যে কোনো বিপদ-আপদে একে অপরের কাছে ছুটে যেতেন। যখনই মুসলিম দেশে কোনো অমুসলিম প্রজা নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তখনই মুসলিম আলেমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

অন্যায় প্রতিরোধে পারস্পরিক সহযোগিতা

আব্বাসীয় খলিফা মামুনের সময় বুশমার অঞ্চলের কিবতিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করেন। এই ব্যাপারে তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট আলেম ও মিসরের প্রধান বিচারপতি ও মালেকি মাজহাবের মুফতি হারেস ইবনে মিসকিনের কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেন। এতে খলিফা মামুন তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

আর যখনই কোনো সরকার কোনো নিপীড়নমূলক নীতি অবলম্বন করেছে, তখনই মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে সোচ্চার হয়েছে। শাসকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে।

আরেকবার দামেশকে সরকারের অন্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ইহুদি-খ্রিস্টান ও মুসলমান সবাই মসজিদে এসে সমবেত হয়। প্রত্যেকেই নিজেদের ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে দোয়ায় অংশ নেয়।

৩৯৪ হিজরিতে সিরিয়ার মুসলমানদের ওপর ফাতেমি খলিফার নির্যাতন নিপীড়ন বেড়ে যায়। মুসলমানদের এই করুণ দশা দেখে সরকারের উচ্চপদস্থ এক খ্রিস্টান কর্মচারী আতঙ্কিত হন। তার সঙ্গে বাদশার বোনের পরিচয় ছিল। তখনই তিনি তার কাছে চিঠি লিখে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য অনুরোধ জানান। বাদশাহ তার বোনের কাছে পরামর্শ নিয়ে কাজ করতেন। বাদশার বোন এই চিঠি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহকে সিরিয়ার মুসলমানের ওপর নির্যাতন বন্ধের অনুরোধ করেন। বাদশাহর নির্দেশে নির্যাতন বন্ধ হয়ে যায়।

সহানুভূতি ও সমবেদনা জানানো

মুসলমান-খ্রিস্টান-ইহুদিরা একে অপরের সুখে-দুঃখে পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সান্ত¡না ও সমবেদনা জানিয়েছে। ৯ হিজরিতে হারেস ইবনে আবদুল্লাহ আল-মাখজুমির মা মারা গেলে সাহাবারা সবাই সেখানে যান। তার জানাজায় অংশ নেন। তাকে সমবেদনা জানান। অথচ তার মা ছিল খ্রিস্টান।

১২৮ হিজরিতে ইমাম মানসুর মারা গেলে ইহুদি-খ্রিস্টান সবাই তার জানাজায় আসে। খতিব বাগদাদি লিখেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল মারা গেলে ইহুদি-খ্রিস্টান এমনকি অগ্নিপূজকরাও তার জানাজায় আসে। সবার মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।

যুদ্ধের ময়দানে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। সুলতান গিয়াস উদ্দিন সেলজুকি যখন নবুয়তের দাবিদার বাবা তুরকিমানির সঙ্গে যুদ্ধে জড়ান, তখন খ্রিস্টান সৈন্যরা অসামান্য ভূমিকা রেখেছিল। তাতাররা বাগদাদে হামলা চালালে অনেক মুসলমান খ্রিস্টানদের গির্জায় আশ্রয় নেয়। খ্রিস্টানরা তাদের নিরাপত্তা দেয়।

৬৯৯ হিজরিতে তারা দামেশকে হামলা চালায়। অনেক মানুষকে বন্দি করে। তখন ইবনে তাইমিয়া এগিয়ে এসে বন্দিদের মুক্তি দিতে বলেন। তাতার সম্রাট মুসলমানদের মুক্তি দেয়। কিন্তু ইবনে তাইমিয়া বলেন, আমাদের খ্রিস্টান ভাইদেরও মুক্তি দিতে হবে। তাদের মুক্ত করাও আমাদের দায়িত্ব।

ক্রুসেড চলাকালে একবার মুসলমানরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুসলিম শিবিরে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি জাহাজভর্তি রসদ পাঠান। আর সেই রসদ মুসলিম শিবিরে পৌঁছে দেয় লেবাননের খ্রিস্টানরা।

পরিতাপের বিষয় হলো পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্ব ঘরে-বাইরের নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর পরমতসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে থাকে। বিভিন্ন সুবিধাবাদী মহল সাম্প্রদায়িক উসকানি বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের লালসা পূরণের জঘন্য অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। ফলে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে অস্থিরতা ও হানাহানি বাড়তে থাকে।

এখন সারা বিশ্বের মানুষের অধিকার হরণ হচ্ছে। অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে সবাই। অস্থিরতা ও অরাজকতায় ছেয়ে যাচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই এখনই সময় এই ঘৃণার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার। সাম্প্রদায়িক হানাহানির এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার। ফিরে যেতে হবে নবীর শিক্ষায়। রাসুল (সা.) অমর বাণী ‘লাহুম মা লানা ওয়া আলাইহিম মা আলাইনা।’ অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকেরই সমান অধিকার এবং দায়িত্ব।

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট