চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

নেপাল ভ্রমণ: পর্ব-৪

হাফেজা আক্তার

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪৬ অপরাহ্ণ

ওর-রে ব্যস! কী দারুণ ব্যাপার সব! পাহাড় চূড়ার উচ্চতা লেখা দেখলাম আট হাজার দুইশত আটষট্টি ফিট বা দুই হাজার পাঁচশত বিশ মিটার। যেনতেনভাবে লেখা নয়। বাঁধানো বোর্ডের উপর সুন্দর করে ইংরেজিতে লেখা,”You are at 8268 ft (2520 m.) above sea level”

সাথে পাহাড়-বনানী-পাখি-আকাশের ছবি। চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কোন জো নেই। রোপওয়ে থেকে নেমে চত্বরে প্রবেশ মাত্রই চোখ পড়বেই পড়বে। আর তারপর শক্ত ইস্পাতের বাঁধানো রেলিং। রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে নিচের সব কেমন আবছা মনে হলো মেঘের আড়ালে। তারপর উঠতে লাগলাম আরো উঁচুতে যেখানে মন্দির রয়েছে। কেমন কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার মত মেঘ ভেসে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে। মেঘের মৃদু ধাক্কায় কেমন শিহরণ খেলে গেল। মনে হচ্ছে যেন অনেকগুলো ফ্রিজারের ঢাকনা খুলে একসাথে শীতল বাতাস বয়ে গেল। যত উপরে উঠছি তত মেঘের আনাগোনা বাড়ছে। শৈশবে খুব মেঘ করে এলে মন কেমন করত। কল্পণায় মেঘে ভেসে যেতাম বহুদূরে। মনে হত মেঘ বুঝি পেঁজা তুলার নরম বিছানা। আর এখন আমি মেঘের ভেসে যাওয়া দেখছি, অনুভব করছি, ধরছি। স্বপ্নীল আবেশে জড়িয়ে ধরেছে। দু’একজন করে বা ছোট ছোট দলে নেপালীরা উঠছে নামছে আর কিছু নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছে। উঠা-নামার পথের পাশে কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রামের জন্য বেঞ্চ পাতা আর পাশেই খোদাই করা বোর্ডে লেখা রয়েছে “ধীরে উঠুন, তাড়াহুড়ো করবেন না। প্রয়োজনে কিছুক্ষণ জিরিয়ে একটু দম নিন”। যথার্থ লেখা। দু’কদম উপরে উঠলেই দম ফুরিয়ে যাচ্ছে আমারই আর যারা বৃদ্ধ বা যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে তাদের কি অবস্থা হয় কে জানে!

একে তো পৃথিবী থেকে যত উপরের দিকে উঠবেন অক্সিজেনের মাত্রা তত কমে যাবে তার উপর পাহাড় বেয়ে উপরের উঠলে আপনাকে মধ্যাকর্ষণের প্রচন্ড চাপ নিতে হবে। এ দুটো কারণে দু’কদমেই দম ফুরায়। ফুরালেও ক্ষতি নেই। এরকম গম্ভীর প্রকৃতি আপনার ভিতরে এক ধরনের শান্তভাব এনে দিবেই দিবে। মন আর মস্তিষ্ক একই মেজাজে থাকে, একই লয়ে থাকে। দ্বন্দহীন চুপচাপ শান্ত। আপনার ভিতর আর বাহিরে এক অনাবিল প্রশান্তি খেলা করবে যা আপনার ভিতরকে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে দিবে। তার উপর চারপাশ অতিরিক্ত পরিষ্কার আর নিঝুম। মানুষের কথার আওয়াজের চাইতে পোকার আওয়াজ বেশি। দূর থেকে ভেসে আসছে মন্দিরের গান। উঠার পথে দেখলাম চূড়া থেকে নিচে নেমে গেছে পাহাড়ী পথ। মাঝে মাঝে ৮ ফুট বাই ১০ ফুট সাইজের ছোট ছোট উন্মুক্ত বিশ্রামাগার। একটু নেমে একটায় একটু বসলাম। তারপর উঠে মন্দিরের চত্বরে প্র্রবেশ করলাম। কী সুন্দর পরিচ্ছন্ন আর গোছানো। একটা খাবার দোকান, একটা সুভ্যানির দোকান, একটু নিচে বাচ্চা এবং বড়দের প্রয়োজন মিশেলে একটা সবুজ পার্ক আর কোণায় পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে পানির প্রবাহ নিয়ে পানির কতগুলো কল আর আছে কোন এক রাজার তলোয়ার সমেত মূর্তি সাথে নিঝুম পরিবেশ। দুই একজন সেলফি বা ছবি তুলছে সাথে আমরাও। পানির ঝর্ণা থেকে পানি খেতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু রোজা বিধায় পারা গেল না। সহকর্মী কাম বন্ধুকে বললাম পান করতে। উনি কারণ সুধালে বললাম পানির স্বাদ মিষ্টি হবে। জাপানে আমি এ রকম ঝর্ণার পানি পান করেছি। দারুণ খেতে। যেন অমৃত্। মন্দিরের চত্বর থেকে শুরু করে মন্দিরের পুরো নকশা ব্যবস্থাপনায় একদম জাপানী স্টাইল। মানুষগুলোর আচরনও জাপানীদের মত। যার যার কাজে সে নিমগ্ন। হৈ চৈ নেই। তাড়াহুড়ো নেই, কেউ কারো দিকে তাকানো নেই, মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকা, এমন ছ্যাবলামোও নেই, চিৎকার চেঁচামেচি নেই। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকালাম। ৬টা বাজে। আরে আরে রোপওয়ে বন্ধ হয়ে গেল না তো! দু’জনই তাড়াহুড়ো করে নামছি। উঠা যেমন কঠিন নামাও কঠিন। উঠার সময় মনে হয় কেউ বুঝি পিছন থেকে টেনে ধরেছে আর নামার সময় মনে হচ্ছে কেউ বুঝি পিছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে।

একটু তাড়াহুড়োতেই বুঝি গড়িয়ে যাবো। নামার সময় সব নেপালীদের কপালে বড় করে সিদুঁরের টিপ থাকে সম্ভবত মন্দিরের ঠাকুরের আশির্বাদ। আমাদের নেই। আমাদের সাথে একজোড়া বয়স্ক কাপল নামছিল জিজ্ঞাসা করল বিদেশী কি না। বললাম। তারপর দু’চার কথার পর সেলফির জন্য অনুরোধ করলে তুললাম চারজনের সেলফি। আরেকটা ইয়াং কাপল বসে ছিল রাস্তার ধারে, সাথে চার কি পাঁচ বছরের বাচ্চা নিজের মত করে খেলছে। কাপলরা তাকিয়ে দেখছে আমাদের চারজনের সেলফি কসরত। হয়ত চোখাচোখি করলে কথা বলত। তেমনই আগ্রহ খেলা করছে চোখেমুখে। কিন্তু করলাম না, এড়িয়ে গেলাম। আমরা চরম উত্তেজিত। দৌঁড়াচ্ছি প্রায়। হাঁপাতে হাঁপাতে রোপওয়ে বুথে আসলাম ৬টা ১৫তে। জিজ্ঞাসা করলাম, “রোপওয়ে কি বন্ধ?” বলল, আটটায় বন্ধ হবে। ইস্ আরেকটু থাকা যেত। চোখাচোখি করা যেত সাথে সেলফিও। যাক্, ফিরতি পথে বক্সে আমরা আবার দুজন। আনন্দে আত্মহারা। দারুণ ছিল সব কিছু। এপারে নেমে ছোট্ট একটা মিউজিয়াম তারপর বাহির। আচ্ছা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কিভাবে ডাকব? নাম, ফোন নম্বর জানি না বা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটা কোন দিকে? বৃ্ষ্টিটা আর ইলশে গুড়ি নয় মাঝারি থেকে হালকা। গিয়ে বসলাম বাইরের শেডে। ওমা! ভুতের মতো ড্রাইভার হাজির। ট্যাক্সি নিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো এখন ফিরছি কি না। আমরা চন্দ্রগিরি সেলফি বুথে শেষ সেলফিটা নিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম আবার আসবোই আসবো প্রতিজ্ঞা করে।

 

 

পূর্বকোণ/টিএফ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট