চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

ভ্রমণ ডায়েরি -১৪

ইউরোপে অভিবাসনের স্বপ্ন

মো. আজিজুল মওলা

২৫ অক্টোবর, ২০২০ | ১২:২২ অপরাহ্ণ

এইতো সপ্তাহখানেক আগে বসনিয়ার জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশি যুবক ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টায় সে দেশের জঙ্গলে আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়ার খবর আমরা জার্মানভিত্তিক নিউজ চ্যানেল ডয়চে ভেলে-র মাধ্যমে জেনেছি। অবৈধভাবে কোন একটি দেশের সীমানায় প্রবেশ করাকে তারা বলছেন “গেম মারা” । নিউজটি দেখার পর সেই বিষয়ে আপনাদের জানানোর উদ্দেশ্যে কিছু লেখার আগ্রহ জাগল।
কিসের আশায় তারা এদেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল তার দিকে একটু নজর দেই। উন্নত জীবন যাপনের আশায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তের অনেক যুবক ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখে।
এই দেশগুলোতে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এসে এখানকার অভিবাসী হয়েছেন । সুইডেনে দেখলাম, বিভিন্ন দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক-যুবতীরা ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে এদেশে আসে। পড়াশোনা শেষ করে ওয়ার্কপারমিট নিয়ে এদেশে কিছুদিন কাজ করে। অনেকে আবার পড়াশোনার একটি কোর্স শেষ হলে আরেকটি কোর্সে ভর্তি হয় । এভাবে তাদের সুইডেনে অবস্থানকালের সময়কে বৃদ্ধি করে। রেসিডেন্ট পারমিটের জন্য এপ্লাই করে। পরবর্তীকালে রেসিডেন্ট কার্ড পেয়ে গেলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা, উন্নত ও নিরাপদ জীবন, সর্বোপরি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানুষের এখানে থেকে যাওয়ার চিন্তা মাথায় ভর করে। আমার সাথে পরিচিত অনেকেই এদেশে থেকে গিয়েছে। এখানে এসে যারা settled হয়েছেন আমি বলবো তাদের আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের ফসলেই তারা পেরেছেন। ডা. লুৎফর রহমানের “উন্নত জীবন” নামে একটি বইয়ে পড়েছিলাম ‘যে কাজই করো না কেন, তাতে যদি তোমার মন ঢেলে দিতে পারো, তাহলে আর কোন ভয় নেই। বিশ্বাস এবং সুনির্দিষ্ট ইচ্ছার সম্মুখে অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়।’
সুইডেন দেশটির অদ্ভুত কিছু রীতিনীতি আমাকে অবাক করেছে। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অন্যতম প্রধান সমস্যা বলে মনে করা হতো এক দশক আগেও। আর এই দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৬৩% । জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারটা আসলে অভিবাসীদের কারণে ধনাত্মক, তাদেরকে বাদ দিয়ে হিসাব করলে ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর এখানে জনসংখ্যা বাড়ে না বরং কমে। এইজন্য ওরা পৃথিবীর কম সুবিধাসম্পন্ন অথবা যে-সমস্ত দেশ যুদ্ধ-বিগ্রহে জর্জরিত সে-সমস্ত দেশ থেকে মানুষদের আসার জন্য আহবান করে।
ইউরোপে জার্মানির পরেই সুইডেনে খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অভিবাসী লোক বসবাস করে । ইউরোপের এই দেশগুলোতে ধর্মের চেয়ে মানবিকতায় অনেক বড়। সুইডেনে কেউ নাগরিকত্ব পেয়ে গেলে তাকে সুইডিশ ধরে নেয়া হয়। সুইডিশরা যে সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র থেকে ভোগ করে তারাও সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। যে কোন দেশ থেকে আগত ব্যক্তি এদেশের নাগরিকত্ব পায়, এখানে যে কোন পিতা মাতা সন্তান জন্ম দিলে তাদেরকে বড় অংকের ভাতা দেয়া হয় এবং আরো সন্তান জন্মদানের জন্য উৎসাহিত করা হয়। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়-এ দেশের লোকসংখ্যা বছর বছর কমছে তাই তাদের জনসংখ্যাকে ধরে রাখার জন্য অভিবাসীদেরকে আহবান করেন অথবা এদেশের কায়িক শ্রমের কাজগুলোতে তাদেরকে কাজে লাগানো হয়।
সুইডেনের সুপার শপ, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, যাতায়াতের জন্য পাবলিক বাসের ড্রাইভার , অন্যান্য ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য দেশ থেকে এদেশে আগত অভিবাসীরা চালায়। খুব কম সংখ্যক সুইডিশকে দেখলাম গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে পাবলিক বাস চালাতে। আরব এবং আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সুইডিশরা এ কাজগুলো করে।
ইউরোপে ৩ ক্যাটাগরির দেশ রয়েছে। সেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে একটি মাত্র ভিসা নিয়ে ২২ টি দেশে প্রবেশ করতে পারবেন। আবার কয়েকটি দেশ আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু সেনজেন ভুক্ত নয় যেমন, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া, সাইপ্রাস । আবার দেখা যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয় কিন্তু সেনজেনভুক্ত, যেমন আইসল্যান্ড, নরওয়ে, লিচেনস্টেইন, সুইজারল্যান্ড। যাহোক, অভিবাসীদের প্রথম পছন্দের তালিকায়-সেনজেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। যাতে করে একটি দেশে প্রবেশ করলে সে দেশের সুযোগ-সুবিধা না পেলে অন্য কোন দেশে সহজে পাড়ি দিতে পারা যায়। অনেকে কোন একটি দেশে বৈধভাবে হোক আর অবৈধভাবে হোক প্রবেশ করার পর, কাজের সন্ধানে অন্য দেশে চলে যায় এবং সে দেশের ওয়ার্ক পারমিট নেয়ার চেষ্টা করে। এই তো বললাম ছাত্র ছাত্রী হিসেবে ইউরোপে প্রবেশ করার স্বপ্ন। আরো অনেকভাবে ইউরোপে প্রবেশ করা যায়। অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য এপ্লাই করে এটাকে বলে এসাইলাম ভিসা। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে সে তার জন্মভূমি নিজ দেশে নিরাপদ নয় ,সে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ,গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, তার নিজের অথবা তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করা তার জন্য নিরাপদ নয়, বিভিন্ন গ্রাউন্ড তৈরি করে সে ইউরোপের দেশগুলোতে এপ্লিকেশন করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে জার্মানি, তারপরে আছে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ডেনমার্ক ও সুইডেন। আর একটা সিস্টেম আছে অভিবাসী হবার সেটা হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট এর মাধ্যমে। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ইনভেস্ট করার মাধ্যমে সে দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রাথমিক ধাপ পূরণ করতে পারবেন।
ইউরোপের দেশগুলোতে সচরাচর গণতন্ত্র চলে। অনেক সময় উন্নত দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিষের কাঁটা হয়ে যায়, তাদের অভিবাসন নীতির সাথে অসামঞ্জস্যের কারণে। একদিন শুক্রবার বিকালে, মালমো শহরের রোজেন গার্ড নামে এক এলাকায় গিয়েছিলাম, গৃহস্থালির বিভিন্ন টুকিটাকি বাজার এবং সাপ্তাহিক বাজার করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সিটি বাস থেকে নামার পর কিছু লোকজনকে ছোটাছুটি করতে দেখলাম। তাদের দেখাদেখি আমিও ঝটপট একটি সুপার শপে ঢুকে পড়লাম। কেনাকাটা শেষ করে, ডানে বামে তাকিয়ে, পরিস্থিতি বুঝে হাঁটা ধরলাম বাস স্টপেজের কাছে। চিন্তা করতেছি এই ধরনের ঘটনা তো কখনও কোন সময় ঘটেনি, বিষয়টি নিয়ে জানার চেষ্টা করলাম পাবলিক বাসে উঠে পাশের সিটে বসা যাত্রীর কাছ থেকে। তিনি আমাকে যা বললেন তার সারমর্ম হল এই, রোজেন গার্ড এলাকাটি আরব অধ্যুষিত ও আরব বংশোদ্ভূত সুইডিশদের এলাকা। এই এলাকাটিতে মাঝে মাঝে দু একটি ভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়ে থাকে । এলাকায় পুলিশ মাঝে মাঝে এসে টহল দিয়ে যায়। এই এলাকা নিয়ে শহরের মেয়রও মনে হয় খুব বেশি চিন্তিত। এইখানে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা হয়। সুইডেনে আরব বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের সংখ্যা এত বেশি যে ওরা ভোট দিয়ে চাইলে কোন একটি আইন চেঞ্জ করে ফেলতে পারে আবার হয়তোবা শরিয়া আইন জারির জন্য প্রস্তাবও করে বসে থাকতে পারে। এজন্য সুইডেনের সরকার ওদেরকে খুব টেকনিক্যালি হ্যান্ডেল করে। বিষয়টি আমাকে খুব বেশি ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। আসলে ঘটনা সত্যি।
গণতন্ত্র সবসময় ভালো কিছু বয়ে আনবে বিষয়টি সে রকম নয় ।
লেখক পরিচিতি: উপ সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট