চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ভ্রমণ ডায়েরি

প্রযুক্তি নির্ভর দেশ সুইডেন

মোহাম্মদ আজিজুল মওলা

১ অক্টোবর, ২০২০ | ১১:৫১ অপরাহ্ণ

নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড তিনটি দেশ একই সারিতে পাশাপাশি ভাবে পৃথিবীর উত্তর মেরুর দিকে অবস্থিত। এগুলো আসলে নরডিক কান্ট্রি। এই দেশগুলোর সেটআপ প্রায় একই রকম । ভৌগলিক অবস্থান এবং জলবায়ুও প্রায় একই রকম। শীতকালে এখানে তুষার পড়ে। তবে কখনও ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মুখোমুখি হয়েছে বলে জানা যায়নি। শীতকালে দিন খুবই ছোট হয়, আর গরমকালে সূর্য ডুবে রাত দশটায়। সামারে রমজানের সময় এদেশের মুসলমান কমিউনিটি রোজা রাখে প্রায় ২০ থেকে ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত। আমরা ছোটবেলায় কল্যাণকর রাষ্ট্র অর্থাৎ ওয়েলফেয়ার স্টেট নামে একটি পৌরনীতির টার্ম পড়েছিলাম। এই দেশগুলো সত্যিকার অর্থে ওয়েলফেয়ার স্টেট। এখানে বয়স্ক ভাতা, বিভিন্ন ক্যাটাগরির পেনশন স্কিম, ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ ফ্রী শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, সুশৃংখল করে যাপন ব্যবস্থা, পিতা-মাতা উভয়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা ইত্যাদি সব সুযোগ-সুবিধা এই দেশটিকে প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।

এই দেশটিতে আমি জাতিসংঘের ফেলোশিপ নিয়ে এসেছি বাংলাদেশ থেকে। ওরা তাই আমাকে স্ট্যাটাস দিয়েছে- ডিপ্লোমেটিক স্ট্যাটাস। অনেক অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি আমার কাছে একটি বিশেষ সুবিধা হল এই শহরের যেকোন বাস আমার জন্য ফ্রি। সুইডেনের বাস গুলোতে আপনি টাকা নিয়ে উঠতে পারবেন না, এখানেও কার্ড সিস্টেম-প্রিপেইড কার্ড। এমনিতে একটি সিটি বাসে একবার উঠবেন আর নামবেন আপনাকে ২০ ক্রোনার খরচ করতে হবে। আপনার কার্ড থেকে অটোমেটিক্যালি প্রতি বার পানস এ কেটে নিবে। বাংলাদেশি টাকায় -২০০ টাকার মতো। সেটি এক কিলোমিটারের রাস্তা হোক আর ২০ কিলোমিটার এর রাস্তা হোক ভাড়া কিন্তু একই। যেহেতু আমার বাসে চলাচল ফ্রি আর টাকাও সেভ হচ্ছে, সেহেতু ভ্রমণপিপাসু মানুষ হিসেবে এই সুবিধাটা আমাকে ভ্রমণের আরো বেশি উৎসাহিত করেছে।

গতপর্বে সুইডেনের মানুষের কার্ডের ব্যবহার নিয়ে বলেছিলাম। কার্ডের বিষয়টা একটু খোলাসা করে না বললে নয়। আমাদের দেশে তালা চাবি দিয়ে ঘর দোকানপাট, অফিস সবকিছুকে সুরক্ষিত রাখা হয়। এখানে তালা আছে ঠিকই কিন্তু চাবি নেই। চাবি হচ্ছে পাসওয়ার্ড অথবা একটা প্লাস্টিক কার্ড। কার্ড এর ভিতরে সমস্ত ইনফরমেশন দেওয়া আছে। কার্ড দিয়ে আপনি বাড়ি ঘরে ঢুকবেন। কার্ড দিয়ে আপনি ইউনিভার্সিটি ঢুকবেন-আর বের হবেন; ভার্সিটিতে আপনার জন্য নির্দিষ্ট লকার রয়েছে-সেখানে আপনার পার্সোনাল জিনিসপত্র থাকবে এবং ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সময়ে সময়ে বিভিন্ন রিপোর্ট আপনার লকারে রাখবে, সেই লকারও পাসওয়ার্ড অথবা কার্ড সিস্টেম, আপনি জিমে মেম্বার হলেন অথবা কোন সুপারশপের মেম্বার হলেন , ওদের পক্ষ থেকে আপনাকে একটা প্লাস্টিক কার্ড দিবে, এখানে সমস্ত ডাটা -আপনার এন্ট্রি আউটগোয়িং সবকিছুই কার্ড এর ভিতরে আছে, কি পরিমান লেনদেন করেছেন সেটাও এন্ট্রি হয়ে যাবে অটোমেটিক্যালি, ইদানিংকালে কিছু কিছু ডাক্তারের চেম্বারও কার্ড সিস্টেম । ইনসুরেন্স কোম্পানিগুলো আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে সুরক্ষার আওতায় ইন্সুরেন্স কার্ড /পাবলিক হেলথ কার্ড দিবে , আপনি যতবারই ডাক্তারের কাছে যাবেন সব ডাটা সেখানে এন্ট্রি হয়ে যাবে অটোমেটিক্যালি আত্মতত্ত্ব চলে যাবে সংলিষ্ট কোম্পানির কাছে আর মেম্বারশিপ এর মেয়াদ চলে গেলে কার্ডের মেয়াদও শেষ। আবার কিছু কিছু জায়গায় আপনার চোখের রে এবং হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল এর ছাপই হল পাস। আপনি বড় কোন ব্রিজ বা টোলপ্লাজা ক্রস করবেন, আপনাকে আপনার চলন্ত গাড়ি থামিয়ে টাকা দিতে হবে না, গাড়িতে কার্ড রাখার একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে, কার্ডটি আপনি সেখানেই রাখবেন, আপনি ১০০ কিলোমিটার পার আওয়ার স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যান এক সেকেন্ডের জন্যও ব্রেকে পা দিতে হবে না, আপনার কাছ থেকে অটোমেটিক্যালি টোল এর এর টাকা কেটে নিবে সরকার।

আগেই বলেছি সুইডেন হল একটি অত্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর আর পরিবেশ বান্ধব দেশ। এখানকার সবকিছুই পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করতে হয়। কিছু কিছু বাড়িঘর যেগুলো নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে সেগুলো সবগুলোই সেন্সর করা আপনাকে নতুন করে ইলেকট্রিক্যাল এর সুইচ দিতে হবে না আপনি রুমে অবস্থান করলেই নির্দিষ্ট জায়গায় আলো চলে আসবে অর্থাৎ লাইট অন হয়ে যাবে আপনি স্থান পরিত্যাগ করার সাথে সাথেই লাইট অফ হয়ে যাবে। কিছু কিছু বিল্ডিংয়ের ছাদ দেখলে মনে হবে আপনি কোন বাগান বাড়িতে আসছেন। পুরা বাড়ির ছাদটা এমন ভাবে তৈরি মনে হবে ঘাসের ভিতরে বাড়ি।

এদেশের কার্ডের ব্যবহার এত বেশি যে, নোট এর ব্যবহার একবারের জন্য হলেও না করে আপনি সারা বছর চলতে পারবেন। বাস ও ট্রেনের টিকেট টিকেটসহ সবকিছুই একটি প্লাস্টিক কার্ড এর ভিতরে সীমাবদ্ধ। সুইডেন এবং ডেনমার্ক খুবই পাশাপাশি দুইটি রাষ্ট্র। বাল্টিক সাগর এর দুই পারে দুটি দেশে অবস্থিত। মালমো এবং কোপেনহেগেন শহর দুইটি যথাক্রমে সুইডেন এবং ডেনমার্কের অবস্থিত কিন্তু তাদের বাস এবং ট্রেনের কোম্পানি এক ই –Skånetrafiken। শহর দুটির যেকোনো একটিতে আপনি যদি আসেন সেদিনের জন্য সারাদিন বাস এবং ট্রেন ভ্রমণ আপনার জন্য ফ্রি। একটু পরিষ্কার করে বলি আপনি ডেনমার্ক থেকে সুইডেনের মালমো শহরে আসলেন ট্রেনে করে। আসার পর সমস্ত সিটি বাস আপনার জন্য ফ্রি ভ্রমণ সেদিনের জন্য। আবার ঠিক একইভাবে, সুইডেন থেকে ট্রেনে বা বাসে করে আপনি আসলেন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন। এখানেও সারাদিন আপনার জন্য সমস্ত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ফ্রী। ওই একটা টিকিট এর কপি আপনার জন্য ওই দুটি শহরের ঘুরাঘুরির জন্য সারাদিনের পাস । মনে মনে বলি আমাদের দেশের এক মোবাইলে দুই সিম ব্যবহারের মত আর কি !

(চলবে)

লেখক পরিচিতি-
উপ সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট