চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পর্ব-২৭ঃ তাল আগ্নেয়গিরি দেখা

মো. ফারুক ইসলাম

৯ জুলাই, ২০২০ | ৫:০৪ অপরাহ্ণ

আমরা তাল লেকের পাড় থেকে স্পিড বোটে রওনা দিলাম তাল আগ্নেয়গিরির উদ্দেশে। সবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট। প্রচণ্ড বাতাস লেকে। চারদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে ১০/১৫ মিনিট পর তাল লেক পার হয়ে গেলাম। সবাই বোট থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম। ছোট্ট একটা গ্রামে আমরা প্রবেশ করলাম। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ, মৎস্য আহরণ এবং ঘোড়া নিয়ে তাল ভলকানোতে যাবার গাইডের কাজ করেন। গ্রামে প্রবেশ করে সবাই একটা গাছের নিচে বসলাম। আমাদের বোট ভাড়া আর ঘোড়ায় করে তাল আগ্নেয়গিরির পাহাড়ে উঠার খরচ ছিলো ১২০০ পেসো। ঘোড়ার পিঠে আহরণ করলেও ঘোড়ায় করে পাহাড়ের শীর্ষে ওঠা এটাই প্রথম। সবাই একেক করে ঘোড়ায় আরোহণ করতে লাগলেন। আমি আর বাহারুল ইসলাম স্যার সবার শেষে ঘোড়ায় উঠলাম। তবে বাহারুল ইসলামের স্যারের প্রথম ঘোড়াটি খুবই দুর্বল ছিলো সেজন্য স্যার ঘোড়া পরিবর্তন করছিলেন। শহিদুল ভাই তো ঘোড়ার পিঠে উঠে ভয়ে কাঁবু। এদিকে, প্রত্যেক ঘোড়ার সাথে ছিলেন ঘোড়ার মালিক। যারা ঘোড়ার রশি ধরে কাদা মাটির আঁকা-বাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের তাল আগ্নেয়গিরির চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘোড়ায় ধরে বসার মতো কোন দড়ি ছিলো না। ছোট্ট কাঠের একটা খুঁটি ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ঘোড়া একটু দ্রুত দৌড়ানোর চেষ্টা করলে আমি আস্তে আস্তে হাঁটানোর জন্য ঘোড়ার মালিককে অনুরোধ করতে থাকি। মনে হয় জীবনে প্রথম জীবন-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা সবাই লাভ করেছিলাম। তবে আমাদের দলে সবচেয়ে বেশি সাহসী যদি কেউ থেকে থাকেন তিনি হলেন মনি আপা। তিনি এক হাতে কাঠের খুঁটি, আরেক হাতে ফেসবুকে লাইভ দেখাচ্ছিলেন সবাইকে। সত্যি! কাজটা খুব দুঃসাহসিক ছিলো। কারণ কোন কারণে ঘোড়ার পা পিছলে গেলে পাহাড় থেকে অনেক নিচে পড়ে মৃত্যু অনিবার্য ছিলো। এরপরও মনি আপার দুঃসাহসিক কাজে সত্যি ভয় পেয়েছিলাম।

তাছাড়া ওখানে যাবার কোন রাস্তা নেই। খাড়া পাহাড়ে কাদা মাটির পথ পাড়ি দিতে হচ্ছিল। আমাদের ৪/৫ জন সহকর্মী ভয়ে তাল লেক পার হননি। কারণ তারা সাঁতার জানেন না। এদিকে, যাত্রা পথে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হালিমা আপাকে নাকি ঘোড়া থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিল। তিনি একটু ব্যথাও পেয়েছিলেন। হালিমা আপা নাকি ফাজিল ঘোড়ার মালিককে ঘোড়া থেকে নেমে কষে চড়ও মেরেছিলেন তার বেয়াদবির জন্য। তবে সে সময় ব্যাপারটা আমি জানতাম না। বাংলাদেশে এসে ঘটনাটা শুনেছি। ধুরু ধুরু বুকে অনেক কষ্টে তাল আগ্নেয়গিরির চূড়ায় সবাই পৌঁছলাম। এবার জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে চারপাশের প্রকৃতি দেখছিলাম। এ যেন ভয়ংকর সুন্দর! মানে একদিকে মৃত্যুর হাতছানি, অন্যদিকে সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি দেখে মুগ্ধতা। কষ্ট করে না গেলে বুঝতেই পারতাম না এতো সুন্দর তাল আগ্নেয়গিরি এবং আগ্নেয়গিরির পরিবেশ। সবাই তো মহাখুশি। ছবি তুলতেই আছি। যেন ছবি তোলা শেষই হচ্ছে না। তাল আগ্নেয়গিরির লেকের পানি একদম সবুজ। ভালো করে নিচে তাকিয়ে দেখলাম জ্বলন্ত আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। মানে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হওয়ায় এই অবস্থা। উদগীরণ হলেই বুঝা যায় তাল আগ্নেয়গিরির ভয়ংকর রূপ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর শীতল পরিবেশে খুব ভালোই লাগছিল। তবে রোদ থাকলে বেশিক্ষণ থাকাটা খুবই কষ্টকর হতো। বইপত্রে আগ্নেয়গিরির কথা শুনলেও এই প্রথম স্বচক্ষে কোন সক্রিয় আগ্নেয়গিরি দেখলাম। আবহাওয়া সুবিধার না তাই এবার ফেরার পালা। সবাই ঘোড়ায় আরোহণ করলাম। এবার উঁচু থেকে নিচে নামার পালা। উঠতে যেমন কষ্ট, নামতেও কম কষ্ট না। এরপরও মনে সাহস সঞ্চার করে সবাই আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসলাম। এই এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা! নিচে এসে একটা গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। এবার পুনরায় স্পিডবোটে তাল লেক পাড়ি দেবার পালা। এক বোটে আমরা তিনজন। বোট চলতে লাগলো। লেকের মাঝখানে যেতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। লেকের পানিতে ঢেউ আর বৃষ্টি দুটো মিলিয়ে ভয়ংকর পরিবেশ। সবাই ভিজে একাকার। খুব ঠাণ্ডাও লাগছিল। বৃষ্টির মধ্যে অবশেষে তাল লেকের কিনারায় আসলাম। সবাই বোট থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম বৃষ্টি থামা অব্দি। বৃষ্টি থামা মাত্র সবাই গাড়িতে উঠে পড়লাম। এবার ফেরার পালা। বাতাঙ্গাস শহরে পৌঁছে মার্কেটে আমরা কেনাকাটা করতে লাগলাম। কেনাকাটা সারতে সারতে রাত হয়ে গেছে। এদিকে, বাহারুল ইসলাম স্যার সবাইকে খুঁজতে লাগলেন। কারণ পাহাড়ি এলাকা থেকে রাতে ফেরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বাইরে তখন প্রচুর বৃষ্টিও হচ্ছিল। এক ধরনের উৎকণ্ঠা নিয়ে রাত দশটার দিকে সবাই হোটেলে ফিরেছিলাম। এবার ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর পালা। কারণ পরদিন সকালে আমাদের বাংলাদেশে ফিরতে হবে। ফিলিপাইনে সফরের আজ শেষ রাত। অনেক স্মৃতি আর অভিজ্ঞতায় ভরা একটা সফর।
পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট