চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পর্ব-২২ঃ প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠান

৪ জুলাই, ২০২০ | ৭:২৪ অপরাহ্ণ

দুপুরের খাবার খেতে আমরা পাকিস্তানি বাবুর্চির সেই রেস্টুরেন্টে গেলাম। আমাদের সাথে ছিলেন ড. জোয়েল সি. জেভিয়ার, জেসন অর্নিডো, আন্না কারিনা এস. বাতিস্তা। লাঞ্চ শেষে আমরা ইউপি ক্যাম্পাসে ফিরে আসলাম। আমাদের আরেকটা লেকচার সেশন বাকি ছিল। এই একটি সেশন শেষে প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠান। আমাদের শেষ সেশনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটা সেশন। রিক্রুইটমেন্ট এন্ড সিলেকশন অফ টিচার্স এন্ড টিচার এডুকেটর্স বিষয়ে সেশন পরিচালনা করেন প্রফেসর ম্যারিয়েন ক্রিস্টিন ভি. প্যাট্রিয়াকা. অসাধারণ উপস্থাপন দেখে সবাই বিস্মিত হয়েছিলাম। কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। প্রশিক্ষণে যারা প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল ওনার সেশন। পাবলিক স্কুলগুলোতে কিভাবে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এ সম্পর্কে তিনি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সেশনে উপস্থাপন করতে লাগলেন। আমাদের যেমন বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের জন্য শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা হয় ফিলিপাইনেও পাবলিক স্কুলে শিক্ষকতা করতে হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের শিক্ষকতার লাইসেন্স নিতে হয়। ফিলিপাইনে সাধারণত পাবলিক স্কুলে শিক্ষকতা করার লাইসেন্সের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। এলিমেন্টারি স্কুলগুলোর দুটো অংশ রয়েছে। সেগুলো হলো-(১) প্রফেশনাল এডুকেশন এবং (২) জেনারেল এক্সাম। সেকেন্ডারি লেভেলের তিনটি পার্ট। সেগুলো হলো-(১) ফিল্ড অব স্পেসেলাইজেশন এডুকেশন (২) প্রফেশনাল ও (৩) জেনারেল। শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর না পেলে কোন শিক্ষক পাবলিক স্কুলগুলোতে যোগদান করতে পারেন না। এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা হলো কমপক্ষে স্নাতক। শুরুতেই শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয় ৪০০ ডলার। যা ফিলিপাইনের ২০ হাজার পেসোর বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০ হাজার টাকার কাছাকাছি। আমাদের দেশের শিক্ষকদের মধ্যে বেতন নিয়ে হতাশা বিরাজমান। তাই আমরা সব সময় কোন সেক্টরে কত টাকা বেতন দেয়া হয় তা নিয়ে কৌতুহল বশত প্রশ্ন করি। প্রশিক্ষণেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

আমাদের মধ্যে থেকে অনেকেই ফিলিপাইনে শিক্ষকদের কত টাকা সম্মানী দেয়া হয় তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। আমাদের প্রশিক্ষণের শেষ দিনে এসে শেষ সেশনের আলোচনায় সবাই তা জানলো সেই সাথে ফিলিপাইনের শিক্ষকরাও জানলেন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের সময় প্রারম্ভিক সম্মানী কত। তবে গর্বের বিষয় হলো আমাদের আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে। কিন্তু ফিলিপাইনের নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। তাদের মুখের ভাষা তারা ইংরেজি বর্ণের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। প্রশিক্ষণের শেষ সেশন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হলো। এবার কিন্তু সত্যি সত্যি কিছুটা খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল ছাত্র হিসেবে সেই কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনটাতে ফিরে গেছি। সেশন শেষে সবাই মুক্ত আলোচনায় অংশ নিলাম। এরপর একজন প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে বলা হলো। আমরা বান্দরবানের লামা উপজেলার শিক্ষক সুইচিং মারমাকে পাঠালাম সবার পক্ষ থেকে। তিনি খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রশিক্ষণ সম্পর্কে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলেন। এবার সার্টিফিকেট প্রদানের পালা। এর আগে আমাদের সবার উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন কলেজ অব এডুকেশনের ডিন জেরোম বুয়েনভায়েজ। এরপর আমাদের টিম লিডার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বাহারুল ইসলাম স্যার এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব ফারুক আলম স্যার নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করলেন। সেই সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলো ধরলেন। সার্টিফিকেট প্রদানের পূর্বে বাংলাদেশ থেকে নেয়া আমাদের পক্ষ থেকে কিছু শুভেচ্ছা উপহার ইউপি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, প্রশিক্ষকদের হাতে তুলে দিলেন আমাদের টিম লিডার বাহারুল ইসলাম স্যার। এরপর প্রফেসর ড. ম্যারিয়েন ক্রিস্টিন প্যাট্রিয়াকার সুন্দর উপস্থাপনায় একে একে সবার নাম ঘোষণা করা হলো সার্টিফিকেট গ্রহণ করার জন্য। আমি সার্টিফিকেট গ্রহণের সবগুলো ছবি খুব সতর্কতার সাথে তুলতে লাগলাম। কারণ এত বড় একটা প্রাপ্তির স্মৃতি যদি কোন কারণে ঝাপসা উঠে তাহলে সবার মনে একটা আফসোস থেকে যাবে। তাই একটু বাড়তি সতর্কতা বলা যায়। এদিকে, মনে মনে বেশি সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেছিলাম যেন আমার ছবিটা ঠিকঠাক মতো ওঠে। কারণ ছবি তোলার হাত সবার এক রকম না। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু না, কুঁড়িগ্রামের শিক্ষিকা চৌধুরী শারমিন শামস মনি আপা খুব সুন্দর করেই আমার সার্টিফিকেট গ্রহণের ছবিটি তুলেছিলেন।

তাকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। আমার পুরো ট্যুরের অধিকাংশ ছবিই মনি আপার হাতে তোলা। সমাপনী পর্বে ফটো তোলার জন্য নির্দিষ্ট সময় ছিলো। তাই আমরা সার্টিফিকেট গ্রহণ শেষে সবাই ইচ্ছে মতো ফটোসেশন অংশ নিলাম। উল্লেখ্য, প্রশিক্ষণের শেষ দিন আমাদের ইউপি’র কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরি, সুবিশাল হল রুম, বিভিন্ন অর্জনের ছবি দেখানো হলো। ইউনিভার্সিটি অফ দ্যা ফিলিপাইন্সের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিশাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনও তাই কম না। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা যে, এমন একটি গৌরবময় সুযোগ তিনি আমাকে করে দিয়েছেন। লাখো কোটি শুকরিয়া মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে। শুধু আমি না যারাই এমন সুযোগটা পেয়েছেন সবাই নিশ্চয় আমার মতো নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ। বিকাল পৌণে পাঁচটার দিকে আমাদের প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠান শেষ হলো। সবাই বাইরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনটিজ হলের সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো কয়েকটা গ্রুপ ছবি উঠালাম। এবার বিদায়ের পালা। তবে বিদায় নিতে মন চাইছিল না। ইউপি’র সকল সদস্যদের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ ছিলাম। বুঝতেই পারিনি কোন প্রশিক্ষণে এসেছি। পিএইচডি ডিগ্রিধারী একেকজন প্রফেসর যখন নিজেরাই আমাদের সামনে নাস্তার প্লেট এনে দিচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল ওনাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু আছে। আমাদের দেশে অনেকেই আছেন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হলে অতীত ভুলে যান, কিংবা মানুষকে যোগ্য মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। ফিলিপাইনে এসে দারুণ অভিজ্ঞতা হলো প্রফেসরদের এমন নিরহংকারী মনোভাব দেখে। বিদায়কালে ইউপি’র যত স্টাফের সাথে দেখা হয়েছিল সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। জানি হবে না আর দেখা, তবে মন বলছে এই দেখা শেষ দেখা নয়। আবার দেখা হবে, হয়তো সামনাসামনি না। বর্তমান ভার্চুয়াল জগতে একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগটা কঠিন কিছু না। শুধু প্রয়োজন একটু আন্তরিকতা আর যোগাযোগের জন্য সময় বের করা। গাড়ি চলতে লাগলো আর আমরা হাত নেড়ে সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানালাম। বিদায় ইউপি——–

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট