চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পর্ব-১৭ঃ নিনয় একুইনো এলিমেন্টারি স্কুল পরিদর্শন

মো. ফারুক ইসলাম

২৯ জুন, ২০২০ | ১:২৮ অপরাহ্ণ

রেষ্টুরেন্টের সামনে থেকে গাড়ি ছাড়ল। গাড়িতে গান, গল্প আর আড্ডায় সবাই মেতে আছি। আমাদের বাহারুল ইসলাম স্যার এবং ফারুক আলম স্যারও সবাইকে নিয়ে আনন্দে শরিক হলেন। যা যা মনে আসছে প্রত্যেকেই বলে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। প্রজেক্ট এসিসটেন্ট জেসন অর্নিডো আর আন্না কারিনা এস বাতিস্তা আমাদের আনন্দ দেখে ভাষা বুঝতে না পারলেও উপভোগ করছিলেন। বৃষ্টি আর আমাদের আনন্দ মিলেমিশে একাকার। কবির ভাষায়- ‘‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা।” আসলেই তো কোন মানা নাই, নেই গতানুগতিক কাজের চাপ। প্রাণ খুলে ভ্রমণ উপভোগ করছি আর ভিনদেশের পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতা লাভ করছি। আড়াইটার দিকে আমাদের গাড়ি এসে থামলো নিনয় একুইনো এলিমেন্টারি স্কুলের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম অভিভাবকরা স্কুলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন তাদের সন্তাদের জন্য। ভেতরে ঢুকা মাত্র স্কুলের শিক্ষকগণ আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। আমাদের দেখে অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই উৎফুল্ল। তাছাড়া ফিলিপাইনের মহিলাদের পোশাক থেকে আমাদের বাংলাদেশি নারী শিক্ষকদের পোশাক ছিলো ভিন্ন। বিশেষ করে শাড়ি পরা শিক্ষিকাদের দেখে অনেকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন। স্কুলে প্রবেশ করে প্রথমেই শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়লাম। এখানে শিক্ষার্থীর দেখা মিললো। কোমলমতি, ফুটফুটে শিশুরা দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাগতম জানালো। সবাই ওদের নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। এরপর শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতিও পর্যবেক্ষণ করছিলেন ফাঁকে ফাঁকে। স্কুল ক্যাম্পাসটা অনেক সুন্দর। আমরা কয়েকজন বাইরের পরিবেশটা ঘুরে ফিরে দেখলাম। শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন শেষে সবাইকে একটা কক্ষে নিয়ে বসানো হলো। এবার হালকা অ্যাপায়নের পালা। নাস্তার মেন্যু দেখে সবাই হতবাক হয়ে গেলাম। একি দেখছি! কাঁচা কলাকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে পরিবেশ করা হয়েছে। সাথে সাধারণ পানি। এই ঘটনা যদি আমাদের দেশে হতো নির্ঘাত অতিথিরা মাইন্ড করতেন। এরপরও ভদ্রতার খাতিরে সিদ্ধ কলা সবাই একটু করে মুখে দিয়ে রেখে দিলেন। নাস্তার আইটেম দেখে হাসতে পারছিলাম না সবাই আছেন বলে। শুধু একজন আরেকজনের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম। যাই হোক একেক দেশের আতিথেয়তা একেক রকম। হয়তো ফিলিপাইনের মানুষের জন্য সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। নাস্তার পর্ব শেষে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের মতো আয়োজন হলো। প্রজেক্টরে বিভিন্ন তথ্য দেখলাম। তবে অনুষ্ঠানের শেষের পর্বটা কখনো ভুলবো না। স্কুলের ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। অসাধারণ কম্বিনেশন, বাজানোর ধরন দেখে মুগ্ধতায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।

 

আমি অধিকাংশ পরিবেশনা মোবাইলে ধারণ করে এনেছি আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রজেক্টরে দেখাবো বলে। সে সাথে তাদের পরিবেশনার ছবি তুলতেও ভুল করিনি। বুঝতে পারলাম স্কুলের সংগীত প্রশিক্ষণটা ভালো ভাবেই হয়। সংগীত শিক্ষকের দক্ষতায় শিক্ষার্থীরা দারুণ পরিবেশনা দেখাতে পেরেছে। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ ছিলো সুসজ্জিত। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের পোশাকগুলো খুবই সুন্দর লেগেছিল। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষটি উপকরণ আর ডিজাইনে সাজানো গোছানো। ক্লাসরুমেই রয়েছে এলইডি টিভি। শিক্ষার্থীদের আনন্দদানের জন্য বিভিন্ন ছড়া, কবিতা, কার্টুন টিভিতে প্রদর্শিত হয়। আবার সাউন্ডবক্সে শিক্ষা বিষয়ক গান বাজিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা নেচে গেয়ে সুন্দর পরিবেশে শিখন শেখানো কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। এক কথায়, প্রাথমিক শিক্ষা উপযোগী যত ধরনের কাজ আছে সবগুলো এখানে বিদ্যমান। প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষিকাকে দেখলাম যথেষ্ট চটপটে আর দক্ষ। আমরা তাঁর পাঠ দেখছিলাম আর মোবাইলে ধারণ করছিলাম। আমাদের শহীদুল ভাই তো প্রাক-প্রাথমিকের মহিলা টিচারের কাঁধে হাত দিয়ে ছবিও তুলে ফেলেছিলেন। আমি তো শহীদুল ভাইয়ের ছবি তোলার ধরন দেখে হতবাক হয়ে গেছি। ছবি তুলছেন আর “ইয়া, ইয়া-ওপেন টু অল ডায়ালগ দিচ্ছিলেন। ভাবছিলাম ভাগ্যিস বাংলাদেশি টিচার না, তাহলে শহীদুল ভাইয়ের কপালে দুঃখ ছিলো। সবাই প্রাক-প্রাথমিকের শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছবি তুললাম। বাচ্চাগুলোকে দেখে খুব মায়া লাগছিল। মনে হচ্ছে একেকটা স্বর্গের দূত। এদিকে, আমাদের ছবি তোলা দেখে কয়েকজন অভিভাবকও এগিয়ে এলেন আমাদের সাথে ছবি তুলতে। সবাই এতো খুশি আমাদের দেখে! স্কুল পরিদর্শন শেষে বের হতে যাবো এমন সময় আরও কয়েকজন শিক্ষক এগিয়ে এসে বললেন,“ আমরা তো শিক্ষক একই ক্যাম্পাসের, কিন্তু ক্লাস ভিন্ন। আমাদের সাথে ছবি তুলবেন না।” আমি তো অবাক! কতো আগ্রহী তারা ছবি তুলতে। তাদের ইচ্ছেটাও অপূরণ থাকবে কেন। ছবি তুলে সেটাও পূরণ করে দিলাম। সত্যি বলতে কি এই স্কুলের পরিবেশটা দেখে মনে হচ্ছিল আমরাও চাইলে পারি এমন একটা ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে। তবে আমাদের না পারার পেছনে অনেক কারণও বিদ্যমান। যদি আমার নিজের স্কুলের কথা বলি তাহলে বলতে হয়, অনেক টাকা খরচ করে বিদ্যালয়ের বাইরে যেইমাত্র রং করালাম। পরদিন এসে দেখি ফুটবলের কালো গোল গোল দাগে ভরে গেছে নতুন রং করা দেয়াল। বর্ষাকালে স্কুলের মাঠ দেখে মনে হয় ধান চাষ করছে কেউ। কোন গাছ রোপণ করলে পরদিন দেখা যায় শিকড়সহ উপড়ে ফেলেছে। অথচ সরকার কতো টাকাই না বরাদ্দ দিচ্ছেন স্কুলের উন্নয়নে। কিন্তু যে এলাকার উন্নয়ন করছি তারাই যদি নিজের এলাকার সম্পদ রক্ষা না করে ধ্বংস করেন তখন কি করার থাকে। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে এসব কিছুই পরিবর্তন হবে। ইতিমধ্যে অনেক স্কুলের পরিবেশ ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। লাল-সবুজ পতাকার রঙে সেজেছে অনেক স্কুল। তাই আমিও আশাবাদী একদিন বাংলাদেশের সব স্কুল হবে শিশুদের জন্য একেকটি শিশু উদ্যান। আমাদের পরিদর্শন কার্যক্রম শেষ করে আমরা গাড়িতে না উঠা পর্যন্ত স্কুলের অভিভাবকগণ স্কুল ছুটির পরও গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের বিদায় দিতে। সবার আন্তরিকতা দেখে অনেক ভালো লেগেছিল। গাড়িতে ওঠার পর হাত নেড়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এবার আমাদের গন্তব্য ফিলিপাইনের আরেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় “নিউ এরা ইউনিভার্সিটি।-(চলবে)

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট