চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিজয় মনন ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:২১ পূর্বাহ্ণ

এটি সর্বজনবিদিত যে, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার সন্দীপ্ত লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ নির্মাণ। বিশ্ব ইতিহাসের স্বাধীনতা প্রাপ্তির অধ্যায়ে এত বেশি প্রাণ বিসর্জনের উদাহরণও বিরল। বিজয় মাসের গৌরবগাথা বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের জন্য এক বিষ্কম্ভক আনন্দ ও অন্তর্দাহের অনুরণন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে হলেও বীরত্বের এই অনুস্যূত উচ্চারণ কোনভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না। সঠিক ইতিহাস চর্চা এবং আগামী দিনে রাজনীতি-রাষ্ট্র শাসনের জন্য মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ, দেশপ্রেমিক নাগরিক প্রস্তুতকরণে বাঙালির দেশ-জয়ের নিখাদ সত্যের কাঠিন্য প্রকাশ অনিবার্য।

কবি নজরুল বলেছিলেন, “অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির, কাপুরুষ ভয়ে কাঁপে লড়ে যাবে বীর।” বীরের জাতিতে ভূষিত বাঙালি কখনো পরাভূত হবার নয়। সকল অশুভ পরাজিত অন্ধকারের অপশক্তিকে নিধন করে এই জাতি এগিয়ে যাবেই-নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘সাবাস বাংলাদেশ এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনস্বর চেতনা জাতির সংসিদ্ধ মননে কতটুকু সার্থক ও কার্যকর, তার অর্থবহ বিশ্লেষণ এখনো তদর্থ প্রয়োজন।
১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিজয় দিবসের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বলেছিলেন, “১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু। স্বাধীনতা সংগ্রামের চাইতেও দেশ গড়া বড় কঠিন। দেশ গড়ার সংগ্রামে আরো বেশি আত্মত্যাগ, আরও বেশি ধৈর্য্য, আরও বেশি পরিশ্রম দরকার।” বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণে বারবার ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী, মুনাফাখোর, দেশের সম্পদ পাচারকারী, মজুদদার এবং অর্থ-ক্ষমতার মোহে পাগলপ্রায় মানুষ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন এবং বাংলার দুখী মানুষের সুখ-শান্তি ও দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা বিনির্মাণে করণীয় উদ্যোগ এবং তা বাস্তবায়নে সোনার মানুষের সন্ধানে নিরলস নিজেকে নিবেদন করেছেন।
শোষণ-বঞ্চনা, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের স্বৈরচারী মনোভাব, সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎমুখিতা, পরনির্ভরশীলতাকে সংহার করে আত্মনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এখনো অধিকাংশে অসম্পূর্ণ। অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, অবৈধ ও অনৈতিক পন্থায় অর্থ ও পেশি শক্তি কীভাবে দেশকে প্রচন্ড পর্যুদস্ত করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে, তা প্রতিনিয়ত আমরা উপলব্ধি করছি। অতি সম্প্রতি ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)’ ঠেকাতে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন করা হবে, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন বাংলায় করতে দেব না। সব ধর্মের লোক এখানে বাস করবেন’ বলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এখনো কীভাবে আমাদের আক্রান্ত করছে; তা সহজে অনুমেয়।

মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মহামনীষীদের জীবনচরিত ও আদর্শ-চলচ্ছক্তির প্রাসঙ্গিকতা প্রণিধানযোগ্য। বিঘোষিত উঁচুমার্গের এই সব কীর্তিগাথা যথার্থ অর্থে প্রোথিত করা না হলে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে নষ্ট চরিত্রের অবস্থানে আমাদের নির্বাসিত করা হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিই বাস্তবতা। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মুর বলেছিলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে যুগে এই ধরিত্রিতে আবির্ভূত হয়ে ছিলেন; তিনি শুধু সেই যুগেরই মনীষী নন বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনীষী। সমাজের সামগ্রিক অসঙ্গতি, শোষণ, অবিচার, ব্যভিচার, সুদ-ঘুষসহ অপরাধমুক্ত সকলের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, আত্নার পবিত্রতা ও মহত্ত্ব, ক্ষমা, ধৈর্য্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও অবিচল কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে স্বীয়-চরিত্রকে বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণ ও অনুস্মরণীয় করে বিশ্বশীর্ষ ভূষণায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ও পবিত্রতম আরাফাত ময়দানে প্রায় এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার সাহাবীর সম্মুখে বিদায় হজ্জ খ্যাত ভাষণের শুরুতেই সম্ভোধন করেছিলেন ‘হে বিশ্ব মানবকূল’ অর্থাৎ কোন বিশেষ সম্প্রদায়, জাতি-রাষ্ট্র বা ধর্ম-বর্ণ নয়, মহান ¯্রষ্টার সৃষ্টির সেরা সমগ্র মানব সমাজের উদ্দেশ্যেই তাঁর এই ভাষণ ছিল বিশ্বশ্রেষ্ঠ মানবাধিকার সনদ।
উল্লেখ্য সনদের তদ্ভাব নির্যাস ছিল বৈষম্যহীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আভিমুখ্য জ্ঞানাঞ্জন, মানুষের পারস্পরিক সৌহার্দ-সম্প্রীতি; ধন-সম্পদ; মান-মর্যাদার রক্ষাকবচ। সনদে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষিত ছিল, “কখনো অন্যের উপর অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না, স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের উপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে, যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না, চাকর চাকরাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইও না, তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তাই খেতে দিবে; তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তাই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দিবে, কোন অবস্থাতেই এতীমের (পিতৃ-মাতৃহীন মানব) সম্পদ আত্নসাৎ করবে না।” এই জন্যেই পবিত্র কোরআনে ¯্রষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, “হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে সমগ্র মানব সমাজের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।”
মনীষী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, শ্রীচৈতন্যসহ জীবনের সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দ অনুসন্ধানে যাঁরা নিরন্তর মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষায় রাজবর্ত্ম উত্তীর্ণ, ধর্মের বিভেদ-বিচ্ছেদে চরম পীড়িত ছিলেন তাঁরা। এমনকি একই হিন্দু ধর্মের মধ্যে শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, সৌর, ব্রাহ্মণ একের প্রতি অন্যের উদ্ধত খড়গহস্ত থেকে পরিত্রাণের জন্য নি¤œশ্রেণির মানুষের জয়গানে তাঁরা নিবিড় প্রকর্ষে মুখর ছিলেন। ধর্মের সাথে ধর্মের, বর্ণের সাথে বর্ণের, উঁচু ও নিচু বর্ণের মধ্যকার বৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের বিভাজন ও নিপীড়ন দূরীকরণে তাঁদের অবদান ছিল অপরিসীম।
রবিঠাকুর মনোগত বেদনাশ্রয়ী হয়ে তাঁর ‘শিশুতীর্থ’ কবিতায় লিখেছিলেন, “রাত কত হ’লো ? উত্তর মেলে না। …সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো, ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে বিভীষিকার উল্কি পরানো। …চলেছে পঙ্গু, খঞ্জ, অন্ধ আতুর, আর সাধুবেশী ধর্মব্যবসায়ী, দেবতাকে হাটে-হাটে বিক্রয় করা যাদের জীবিকা। …দয়াহীন দুর্গম পথ উপলখ-ে আকীর্ণ। ভক্ত চলেছে, তার পশ্চাতে বলিষ্ঠ এবং শীর্ণ, তরুণ এবং জরাজর্জর, পৃথিবী শাসন করে যারা, আর যারা অর্ধাশনের মূল্যে মাটি চাষ করে। কেউ বা ক্লান্ত বিক্ষতচরণ, কারো মনে ক্রোধ, কারো মনে সন্দেহ। তারা প্রতি পদক্ষেপ গণনা করে আর শুধায়, কত পথ বাকি!” কী করুণ কণ্ঠে রবিঠাকুরের অমীয় বাণী আমাদের মানবিক সমাজের অখ- বৈশিষ্ট্যকে এখনো নিরাতঙ্ক প্রতিভাত করছে।

‘জাতির পাঁতি’ কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কী অসাধারণ পংক্তিতে উচ্চারণ করেছেন, “জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি; … দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা, কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা।” মানুষকে মানবিক সমাজের বিশ্ব নাগরিকতা প্রদানের লক্ষ্যে ‘হিন্দু-মুসলমান’ নিবন্ধে কবি নজরুল বলেছেন, “অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি-আলোর মত, সকলের জন্য।”

কোন ধার্মিক অসাম্প্রদায়িক মানবিক ব্যক্তি কখনো বলতে পারেন না আমি একজন হিন্দু বা একজন মুসলমানকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছি। তাঁর সাবলীল কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, “আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি – আমারই মত একজন মানুষকে।” শুধু ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, অমানবিক সমাজের হিং¯্র প্রতিভূরাই এই ধরনের মানসিকতা ধারণ না করে বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করে। কালের পরিক্রমায় তারা হয় অন্ধকারের সাথী, নির্জন দ্বীপের মত নিঃসঙ্গতায় পরিপূর্ণ। বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আসা হলেও বিজয় দিবসের সার্থকতা এখনো অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। বিবেক হয়ে পড়ে বিপন্ন, বিপর্যস্ত। এখনো কেন জানি জাতির প্রত্যাশা পূরণে কবি সুকান্তের “হে মহাজীবন” কবিতার উপচয়ে সোচ্চার হতে হয়, “প্রয়োজন নেই কবিতার ¯িœগ্ধতা- কবিতা, তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় : পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।”
ঃ লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট