চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুফি-সাধকের স্মৃতি বিজড়িত চুনতি প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ এক জনপদ

এম. আহমদ মনির, লোহাগাড়া

১২ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

চুনতি লোহাগাড়া উপজেলার প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ বহুল আলোচিত একটি ইউনিয়ন। প্রায় এক বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট এই ইউনিয়নে অতীতে জন্মগ্রহণ করেন বহু সুফি সাধক, দরবেশ ও খ্যাতনামা জ্ঞানী-গুণীজন। প্রকৃতির অপূর্ব শোভাম-িত পাহাড়-পর্বত, টিলা, গভীর অরণ্যবেষ্টিত সমতল ও বনভূমিঘেরা এই ইউনিয়নের নাম সুদূরপ্রসারী। ইউনিয়নের গাঁ ঘেষে চলে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান মহাসড়ক।

প্রাপ্ত সূত্রে জানা যায়, চুনতি নামের উৎপত্তি হয় ফারসী শব্দ চুনিদাহ থেকে। এ শব্দের অর্থ পছন্দকৃত। উর্দুতে এর অর্থ প্রশংসনীয়। সূত্র মতে, স¤্রাট আকবরের প্রপৌত্র তাজমহল নির্মাণকারী স¤্রাট শাহজাহান ১৬৫৭ সালে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হন। তাই সিংহাসনের দাবিদার হন তার বড় ছেলে দারাশিকো। কিন্তু স¤্রাট শাহজাহানের তৃতীয়পুত্র আওরঙ্গজেব ওই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গিয়ে তার ভাই শাহ সুজাকে সিংহাসন দখলের জন্য প্ররোচিত করেন। সরল বিশ্বাসে শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে নিজকে বাংলার সুলতান ঘোষণা দেন। কিন্তু, স¤্রাট শাহজাহান ও তার বড় ছেলে দারাশিকো এ ঘোষণার বিরুদ্ধে শাহ সুজাকে দমন করার জন্য রাজকীয় বাহিনী প্রেরণ করেন। শাহ সুজা প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে ভারতীয় মহাদেশের উত্তর প্রদেশের খাজুয়া প্রান্তর থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে আশ্রয় নেন। এখানে তিনি স¤্রাট আওরঙ্গজেব’র সুবাদার মীর জুসলার হুমকির মুখে চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব আরকান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শাহ্ সুজা আরকানে যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মাঝপথে টিলা-পর্বতঘেরা এ জায়গায় অবস্থান নেন। আরামদায়ক ও নিরাপদ স্থানকে তিনি চুনিদাহ বলায় পরবর্তীতে শব্দটি পরিমার্জিত হয়ে চুনতি শব্দে নামকরণ হয়। এতে এলাকাটি চুনতি নামে পরিচিতি লাভ করে।
চুনতির পথিকৃৎ শাহ মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) সূত্রে জানা যায়, শাহ সুজা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে নিজ পরিবারের সদস্যবর্গ, ২’শ জন একান্ত অনুগামী এবং ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ইসলামাবাদ হয়ে পর্তুগিজ জাহাজে করে আরকানে যাত্রা শুরু করেন। চট্টগ্রাম হতে সাঙ্গু ও ডলু নদের দক্ষিণ প্রান্তে এসে জাহাজ চলাচল উপযোগী পানিপথ শেষ হলে চুনতির বর্তমান কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের পাদদেশে জাহাজ নোঙর করে। তারপর তারা পায়ে হেঁটে সামান্য দক্ষিণে গিয়ে সুপ্রশস্ত অনুচ্চ একটি পাহাড়ে অবস্থান করে চারিদিকে মনোরম দৃশ্য ও নিরাপদ জায়গা মনে করে শাহ সুজা সেখানে আস্তানা স্থাপনের নির্দেশ দেন। ফার্সি ভাষায় তিনি চুনিদাহ অর্থাৎ পছন্দকৃত উচ্চারণ করেন। সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় চিহ্নস্বরূপ একটি লোহার খুঁটি গেঁড়ে দিয়ে যান। স্থানটিতে লোহার খুঁটি পুঁতে দেয়ার কারণে লোহাগাড়া নামকরণ হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান রচিত ছিদ্দিকী বংশের একটি পারিবারিক ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারত বর্ষের ইতিহাসে সুলতানী আমলে বাংলার রাজধানী গৌড়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন মুহাম্মদ ইউসুফ খানের উত্তরসূরী মাওলানা হাফেজ খান মজলিশ। তিনি বাংলার সুবেদার শাহ সুজার পীর ছিলেন। তিনি শাহ সুজার সফরসঙ্গী হিসেবে চুনতি হয়ে বাঁশখালী বাণীগ্রামে অবস্থান করেন। ১৬৯০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকের কোন একসময়ে হযরত শাহ সুফি নছরত উল্লাহ খন্দকার গৌড় থেকে চুনতি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। নছরত উল্লাহ খন্দকার বড় মিয়াজি এবং তার পুত্র হযরত শাহ শরীফ ছোট মিয়াজি নামে পরিচিত। চুনতি এলাকায় বড় মিয়াজি ও ছোট মিয়াজি মসজিদ এবং সুফি মিয়াজি পাড়া আজ তাদের স্মৃতি বহন করছে। অন্যদিকে ১৬০০ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য একটি দল চুনতি গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। স¤্রাট শাহজাহানের রাজ দরবারের অন্যতম শিক্ষক হযরত ইব্রাহীম খন্দকার শাহ সুজাকে অনুসরণ করে রামু পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে তিনি বাঁশখালীর খানখানাবাদে কিছুদিন অবস্থান করে চুনতি গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, বর্তমান চুনতি জামে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে ঈদগাহ পাহাড়ে তিনি বসতি স্থাপন করেন। শাহ সুজার সফর সঙ্গী ছিলেন ১৮ জন সেনাপতি, ২২ জন উচ্চপদস্থ আলেম ও বিশাল সৈয়দ বাহিনী। শাহ সুজা আরাকানে আশ্রয়ের ৬ মাসের মধ্যে সেখানে নির্মমভাবে খুন হন। এ পরিস্থিতিতে আলেম-ওলামা ও বিশাল মোগল বাহিনীর একটি দল চলে আসেন চুনতি গ্রামে। এ ঐতিহাসিক ঘটনায় ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় চুনতি। সুফি-সাধকের আবাসভূমি বা চারণক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করে গ্রামটি। শিক্ষার প্রভাবও পড়ে গ্রামটিতে। ফলে এখানে গড়ে উঠে আদি পুরুষ ও আদি পরিবারের আবাসভূমি। আদি পুরুষদের মধ্যে হযরত মাওলানা নছরত উল্লাহ খন্দকার, শাহ শরীফ মিয়াজি, সুফী আবদুর রহমান, গাজীয়ে বালাকোট আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.), হযরত মাওলানা ওয়াজি উল্লাহ খান সামী, নাসির উদ্দীন খান ডেপুটি, শুকুর আলী মুন্সেফ, মাওলানা মো. ইউসুফ, হযরত মাওলানা ফজলুল হক, শাহ মাওলানা নজির আহমদ, মাওলানা শাহ আতউল্লাহ হোসাইনী ও শাহ সাহেব কেবলাসহ অনেকে। পরিবারের মধ্যে রয়েছে মিয়াজি পরিবার, সিকদার পরিবার, কাজী পরিবার, ছিদ্দিকী পরিবার, ডেপুটি পরিবার, শুকুর আলী মুন্সেফ পরিবার, মুন্সী পরিবার, ইউসুফ মৌলভী পরিবার ও দারোগা পরিবার। অন্যদিকে চুনতি হাজী রাস্তার ঐতিহাসিক রাফিয়া মুড়া ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে। রাফিয়া মুড়ায় রয়েছে প্রাচীন বটবৃক্ষ ও তেঁতুল গাছ। এ বটবৃক্ষের নিচে এলাকার হাজীগণ সৌদি আরবে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মিলিত হতেন। রাফিয়া মুড়ার পার্শ্ববর্তী কাজীর ডেবা হতে পালের নৌকাযোগে আরবে পাড়ি দিতেন হাজীরা। হযরত খলিফা আবু বক্কর (রা.) এর বংশধর ও ছিদ্দিকী বংশের প্রথম পুরুষ হযরত আবদুল লতিফ ছিদ্দিকী (রহ.) ১৪০০ সালে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরব সা¤্রাজ্যের হেজাজ প্রদেশের গর্ভনর ছিলেন। তিনি আরব থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে লোহাগাড়ায় আসেন বলে ধারণা করা হয়। রাফিয়া মুড়ার পুরাতন তেঁতুল গাছের নিচে এ মহাপুরুষের কবর আছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও কাব্যচর্চায় মোঘল আমল থেকে খ্যাতির শীর্ষে রয়েছে চুনতি। ১৮১০ সালে হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) প্রতিষ্ঠিত চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা উপজেলার প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মোগল ও ব্রিটিশ আমল থেকে দেশে-বিদেশে এলাকাটির রয়েছে অনেক খ্যাতি।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যম-িত এ চুনতি গ্রামের বৃক্ষরাজি, পাহাড় এবং পাহাড়ে সৃজিত বাগান, পাখির কলতান সবমিলিয়ে যেন পর্যটন কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এশিয়ান হাতি প্রজনন কেন্দ্র চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য অঞ্চলটি এ গ্রামে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উভয়পাশে অবস্থিত এ গ্রামটি পুরো চট্টগ্রাম নয়, গোটা দেশে ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতি রয়েছে। এছাড়া সময়ের প্রয়োজনে চুনতির ভাগ্যাকাশে ১৯০৭ সালে প্রজ্জ্বলিত হয় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি হলেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (ম.আ.)। তার পিতার নাম আলহাজ সৈয়দ আহমদ (ম.আ.) এবং মাতার নাম হাজেরা খাতুন। শাহ সাহেব কেবলার ৭ বছর বয়সে মাতা মারা যান। পিতামহ আলহাজ মুফতি মাওলানা কাজী ইউসুফ (রাহ.)’র পারিবারিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়ায় জ্ঞানার্জন করেন। তিনি ক্রমশ আল্লাহ ও রাসূল (স.) প্রেমিক হয়ে জীবন-যৌবন দ্বীনি খেদমতে উৎসর্গ করেন। বিভ্রান্ত মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ ও রাসুল (স.) প্রেমিক করার জন্য ১৯৭২ সালের ১২ রবিউল আউয়াল ১৩ একর আয়তনবিশিষ্ট সীরত ময়দানে ১৯ দিনব্যাপী সীরত মাহফিলের গোড়াপত্তন করেন। তিনি ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বর ভক্ত ও অনুসারীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চিরবিদায় নেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট