চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

লালন-পালনে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি

লাল গরু চট্টগ্রামের ঐতিহ্য

মুহাম্মদ মনির হুসাইন

৫ মে, ২০১৯ | ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লাল গরু চাটগাঁইয়া গরু, সুন্দরী গরু ও অষ্টমুখী গরু বলে পরিচিতি পেলেও অনেকে আবার এ জাতের গরুকে ‘রেড চিটাগাং ক্যাটল’ নামেও চিনে।
বাহ্যিক সৌন্দর্য, মাংস ও দুধের বিশেষ স্বাদের জন্য রেড চিটাগাং ক্যাটল তথা চাটগাঁইয়া লাল গরুর কদর ছিল বহু আগে থেকেই। একসময় চট্টগ্রামের স্থানীয় লোকজন লাল গরু ছাড়া কোনও কোরবানি দিতে চাইতেন না। তাছাড়া মেজবানি কিংবা বিয়েতেও বেশ চাহিদা ছিল এ লাল গরুর। এ গরুর উচ্চমাত্রার শংকরীকরণের কারণে নিজের স্বকীয়তা তথা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি ঘটছে। রেড চিটাগাং ক্যাটল (আরসিসি)-র বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো, হালকা লাল বর্ণের এ জাতের গরু দেখতে ছোট খাটো, পেছনের দিক বেশ ভারি, চামড়া পাতলা, শিং ছোট ও চ্যাপ্টা। এদের মুখ খাটো, চওড়া, মাঝারি ধরনের গল-কম্বল, গলাখাটো ও সামান্য কুঁজ আছে। ওলান বেশ বর্ধিত, বাট সুডৌল, দুগ্ধ শিরা স্পষ্ট, গাভী অনুপাতে লেজ যথেষ্ট লম্বা ও শেষ প্রান্তের লেজের গুচ্ছ লাল বর্ণের। আমাদের দেশে সত্তরের দশক থেকে শংকরায়ন শুরু হয়। এভাবে কৃত্রিম প্রজননের ফলে চাটগাঁইয়া লাল গরু ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। অন্য গরু হতে এই গরুর পার্থক্য হলো এর মাংস ও দুধ খুব সুস্বাদু। তাছাড়া রোগ-বালাই কম হওয়ায় ও প্রাকৃতিকভাবে লালন পালনে অনেক সহজ। সময়ের পরিক্রমা ও মানুষের চাহিদা অনুসারে চট্টগ্রামের লাল গরু সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
বিলুপ্তপ্রায় এ জাতের গরুকে রক্ষা করা ও সংরক্ষণের জন্য পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন উদ্যোগ গ্রহণ করে যা আরসিসি প্রকল্প নামে পরিচিত। চন্দনাইশ উপজেলার বরকল ইউনিয়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাতীয় পর্যায়ে এগারবার পুরস্কারপ্রাপ্ত সংস্থা ‘মমতা’। সম্প্রতি চন্দনাইশ উপজেলার বরকল ইউনিয়নসহ অন্য অঞ্চলে এ গরু লালন-পালনে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি ও তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক ঋণ সুবিধাসহ নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে মমতা। আরসিসি প্রজাতির গরু পালনের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন- এ জাতের গরুর গর্ভধারণের হার বেশি, প্রায় প্রতিবছরই বাচ্চা পাওয়া যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, দুধে চর্বির পরিমাণ বেশি ও প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে এ জাতের গরুর খামার লাভজনক। চট্টগ্রামের ৫টি উপজেলাতে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, এদের দৈনিক দুধ উৎপাদন ২.৭ লিটার, এক বিয়ানে প্রাপ্ত দুধের পরিমাণ সর্বমোট ৫৮১ লিটার, এক বিয়ানে দুগ্ধদানকাল ২১৫ দিন। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৬-৭ বছর বয়সে অথবা ৫ম বিয়ানে দুধের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায় (তথ্য-এআইএস)। মমতা’র আরসিসি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব বিষয় অবগত হওয়ার কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা এখন এই প্রজাতির গরু পালনে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
আরসিসি প্রকল্পের বিষয়ে মমতা’র প্রধান নির্বাহী রফিক আহমদ বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে ও বিলুপ্তপ্রায় এই প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্যে পিকেএসএফ’র সহায়তায় মমতা আরসিসি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে শুরু করেছে ও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে এই প্রজাতির গরু লালন-পালনে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রেড চিটাগাং ক্যাটল বর্তমানে বাংলাদেশের একটি মূল্যবান জেনেটিক রিসোর্স। তাই এটিকে রক্ষা করা ও সঠিক প্রজননের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটানো জরুরি। কিন্তু অপরিকল্পিত প্রজননের কারণে জাতটিতে অন্য জাতের বৈশিষ্ট্যের অনুপ্রবেশ ঘটছে। তাই পরিকল্পিত প্রজনন পদ্ধতি অনুসরণ করে এ জাতটি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জাতের ষাড় থেকে সিমেন সংগ্রহ করে তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষণ করে প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার করতে হবে। সঠিক প্রজনন নীতি অনুসরণই এ জাত সংরক্ষণের কার্যকর পদক্ষেপ।
চট্টগ্রামের লাল গরুর বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রেয়াজুল হক জসীম জানান, এ প্রজাতির গরু ফিরিয়ে আনা বেশ চ্যালেঞ্জিং হলেও এখন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন। তার মধ্যে মমতা পিকেএসএফ’র সহায়তায় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাথে সমন্বয় সাধন করে চন্দনাইশ উপজেলার বরকলে পরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। আশা করা যায়, এ ধরনের উদ্যোগে অচিরেই ঐতিহ্যবাহী গরুর জাতটিকে স্বরূপে ফিরে পাওয়া যাবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট